দ্বিতীয়ে প্রণাম করোঁ মাও বাপ পাত্র ।
যান দয়া হন্তে জন্ম হৈল বসুধায় ॥
পিঁপিড়ার ভয়ে মাও না থুইলা মাটিত ।
কোল দিআ বুক দিআ জগতে বিদিত ॥
অশক্য আছিলঁ মুই দুর্বল ছাবাল ।
তান দয়া হন্তে হৈল এ ধড় বিশাল ॥
না খাই খাওয়াএ পিতা না পরি পরাএ ।
কত দুক্ষে একে একে বছর গোঞাএ ॥
পিতাক নেহায় জিউ জীবন যৌবন।
কনে বা সুধিব তান ধারক কাহন ॥
ওস্তাদে প্রণাম করোঁ পিতা হন্তে বাড় ।
দোসর-জনম দিলা তিঁহ সে আহ্মার ॥
আহ্মা পুরবাসী আছ জথ পৌরজন ।
ইষ্ট মিত্ৰ আদি জথ সভাসদগণ ।
তান সভান পদে মোহার বহুল ভকতি ।
সপুটে প্রণাম মোহার মনোরথ গতি ॥
মুহম্মদ সগীর হীন বহোঁ পাপ ভার ৷
সভানক পদে দোয়া মাগোঁ বার বার ।
শাহ মুহম্মদ সগীর আনুমানিক ১৪-১৫ শতকের কবি। মুসলমান কবিদের মধ্যে তিনিই প্রাচীনতম । তিনি গৌড়ের সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের রাজত্বকালে (১৩৯৩-১৪০৯ খ্রিষ্টাব্দ) ইউসুফ জোলেখা কাব্য রচনা করেন। কাব্যটি পঞ্চদশ শতকের প্রথম দশকে রচিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। কাব্যের রাজবন্দনায় ‘মহামতি গেছে' বলে যাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে তিনি গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ বলে অনুমিত। শাহ মুহম্মদ সগীরের কাব্যে চট্টগ্রাম অঞ্চলের কতিপয় শব্দের ব্যবহার লক্ষ করে মুহাম্মদ এনামুল হক তাঁকে চট্টগ্রামের অধিবাসী বলে বিবেচনা করেছেন। কাব্যের রাজবন্দনায় “মুহম্মদ সগীর তান আজ্ঞার অধীন'-এ কথা থেকে ধারণা করা হয় যে, তিনি হয়ত সুলতানের কর্মচারী ছিলেন কিংবা কাব্যচর্চায় তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। শাহ মুহম্মদ সগীর তাঁর ইউসুফ জোলেখা কাব্যে দেশি ভাষায় ধর্মীয় উপাখ্যান বর্ণনা করতে চেয়েছিলেন, তবে কাব্যে ধর্মীয় পটভূমি থাকলেও তা হয়ে উঠেছে মানবিক প্রেমোপাখ্যান ।
পুরাবাসী- নগরবাসী। বন্দনা- স্তুতি, প্রশংসা। করোঁ - করি। যান- যার। হন্তে- হতে, থেকে । থুইলা- রাখল । অশক্য- অশক্ত, দুর্বল। আছিলু- ছিলাম। মুই- আমি । ছাবাল- ছাওয়াল, ছেলে, সন্তান । তান - তাঁর । গোঙাও- গুজরান করে, অতিবাহিত করে। পিতাক- পিতাকে। নেহায়- স্নেহে। বিদিত- জানা। মনোরথ- ইচ্ছা, অভিলাষ । জিউ- আয়ু জীবিত থাকা। কনে- কখনও। ধারক- ধারের, ঋণের। কাহন- ষোলোপণ, টাকা ।
বাড়- বাড়া, বেশি। দোসর- দ্বিতীয়। মোহার- আমার। সপুটে- করজোড়ে। সভান- সবার । সভানক- সবার। বসুধায়- পৃথিবীতে। তিঁহ- তিনিও। আহ্মার- আমার। বিদিত- জানা। পিঁপিড়ার ভয়ে মাও না ধুইলা মাটিত- মায়ের স্নেহ মমতার তুলনা নেই। মায়ের সদাজাগ্রত কল্যাণদৃষ্টি সন্তানের জীবনপথের পাথেয় স্বরূপ। শিশুকে মা বহু যত্নে লালন-পালন করেন। পিঁপড়ার ভয়ে মা সন্তানকে মাটিতে রাখে নি- এই কথা উল্লেখ করে কবি মায়ের সেই স্নেহ মমতা ও কল্যাণ দৃষ্টিকেই বড় করে তুলেছেন। অশক্য আছিলঁ মুই দুর্বল ছাবাল-এখানে কবি মানব শিশুর শৈশবকালীন অসহায় অবস্থার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। মায়ের আদর-যত্ন ও পরিচর্যা লাভ করে শিশু ধীরে ধীরে পরিণত মানুষ হয়ে উঠে। কবি তাঁর স্নেহময়ী মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে এই পঙ্ক্তিটি ব্যবহার করেছেন।
শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জোলেখা কাব্যের বন্দনা পর্ব থেকে গৃহীত এই কবিতাংশ ‘বন্দনা’ নামে সংকলিত হয়েছে। ‘বন্দনা' পর্ব যথেষ্ট বড়, এখানে শুধু গুরুজনদের প্রতি বন্দনার অংশটুকু স্থান পেয়েছে। কবি তাঁর মূল কাব্যের প্রারম্ভে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রশংসা করেছেন। সংকলিত এই কবিতাংশে জন্মদাতা পিতামাতার ও জ্ঞানদাতা শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন । পিতামাতা অশেষ দুঃখকষ্ট স্বীকার করে পরম যত্নে সন্তানকে বড় করে তোলেন। শিক্ষক জ্ঞানদান করে তাকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। তাই তাঁদের প্রতি অফুরন্ত শ্রদ্ধা দেখাতে হবে। কবি তাঁর কাব্য রচনায় সাফল্য লাভের জন্য সবার কাছে দোয়া কামনা করেছেন। শ্রদ্ধাবোধ ও কৃতজ্ঞতা মনুষ্যত্বের প্রধান ধর্ম । কবিতাংশে তা-ই প্রকাশিত হয়েছে।
বিছমিল্লা প্রভুর নাম আরম্ভ প্রথম ।
আদ্যমূল শির সেই শোভিত উত্তম ॥
প্রথমে প্রণাম করি এক করতার।
যেই প্রভু জীবদানে স্থাপিল সংসার ॥
করিল প্রথম আদি জ্যোতির প্রকাশ।
তার পরে প্রকটিল সেই কবিলাস ॥
সৃজিলেক আগুন পবন জল ক্ষিতি ।
নানা রঙ্গ সৃজিলেক করি নানা ভাঁতি ॥
সৃজিল পাতাল মহী স্বর্গ নরক আর।
স্থানে স্থানে নানা বস্তু করিল প্রচার ॥
সৃজিলেক সপ্ত মহী এ সপ্ত ব্ৰহ্মাণ্ড
চতুর্দশ ভুবন সৃজিল খণ্ড খণ্ড ॥
সৃজিলেক দিবাকর শশী দিবারাতি ।
সৃজিলেক নক্ষত্র নির্মল পাতি পাতি ॥
সৃজিলেক শীত গ্রীষ্ম রৌদ্র ছায়া আর ।
করিল মেঘের মাঝে বিদ্যুৎ সঞ্চার ॥
সৃজিল সমুদ্র মেরু জলচরকুল।
সৃজিল সিপিতে মুক্তা রত্ন বহু মূল ॥
সৃজিলেক বন তরু ফল নানা স্বাদ ৷
সৃজিলেক নানা রোগ নানান ঔষদ ॥
সৃজিয়া মানব-রূপ করিল মহৎ।
অন্ন আদি নানাবিধ দিয়াছে ভুগত ॥
সৃজিলেক নৃপতি ভুঞ্জয় সুখে রাজ ।
হস্তী অশ্ব নর আদি দিছে তারে সাজ ॥
সৃজিলেক নানা দ্রব্য এ ভোগ বিলাস ।
কাকে কৈল ঈশ্বর কাকে কৈল দাস ।।
কাকে কৈল সুখ ভোগে সতত আনন্দ ।
কেহ দুঃখী উপবাসী চিন্তাযুক্ত ধন্ধ ॥
আপনা প্রচার হেতু সৃজিল জীবন ।
নিজ ভয় দর্শাইতে সৃজিল মরণ ॥
কাকে কৈল ভিক্ষুক কাকে কৈল ধনী
কাকে কৈল নিৰ্গুণী, কাকে কৈল গুণী ॥
সৈয়দ আলাওল আনুমানিক ১৬০৭ সালে চট্টগ্রাম জেলার ফতেয়াবাদের অন্তর্গত জোবরা গ্রামে, মতান্তরে ফরিদপুরের ফতেয়াবাদ পরগনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন ফতেয়াবাদের শাসনকর্তা মজলিশ কুতুবের অমাত্য। জলপথে চট্টগ্রাম যাওয়ার সময় আলাওলও তাঁর পিতা পর্তুগিজ জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হন । যুদ্ধে পিতা নিহত হলে আলাওল পর্তুগিজ জলদস্যুদের হাতে পড়ে আরাকানে নীত হন। সেখানে তিনি আরাকানরাজ সাদ উমাদারের দেহরক্ষী অশ্বারোহী সেনাদলে চাকরি লাভ করেন। রাজমন্ত্রী মাগন ঠাকুর তাঁর বিদ্যাবুদ্ধি ও প্রতিভার পরিচয় পেয়ে তাঁকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। তিনি সপ্তদশ শতকের শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে বিবেচিত। তিনি আরবি, ফারসি, হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। এছাড়া তিনি রাগসংগীত, যোগ ও ভেষজশাস্ত্র, সুফিতত্ত্ব ও বৈষ্ণবসাধনা ইত্যাদি বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। আলাওলের যেসব গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে সেগুলো হলো : পদ্মাবতী, সয়ফুলমুলক বদিউজ্জামাল, হপ্তপয়কর, সেকান্দরনামা, তোহফা ইত্যাদি । এ ছাড়া তিনি কবি দৌলত কাজীর অসমাপ্ত কাব্য ‘সতীময়না ও লোরচন্দ্রাণীর শেষাংশ রচনা করেন। আলাওলের কাব্য অনুবাদমূলক হলেও তা মৌলিকতার দাবিদার। আলাওল আনুমানিক ১৬৭৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
হামদ- সাধারণ অর্থ : প্রশংসা, বিশেষ অর্থ : আল্লাহর প্রশংসা। বিছমিল্লা- আল্লাহর নামে শুরু করা, কোনো কাজ শুরু করার আগে মুসলমানেরা 'বিসমিল্লাহ' বলেন। পূর্ণ বাক্যটি হলো : বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। অর্থ : আমি পরম দয়ালু আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি। করতার- কর্তা, প্ৰভু । প্রকটিল- প্রকাশ করল। কবিলাস- কৈলাস বা স্বর্গ। ক্ষিতি- মাটি। সপ্ত মহী- সাত স্তর বিশিষ্ট পৃথিবী। নর্ক- নরক । সপ্ত ব্রহ্মাণ্ড- সাত স্তর বিশিষ্ট আকাশ। চতুর্দশ ভুবন- পৃথিবীর সাত স্তর এবং আকাশের সাত স্তর মিলে চতুর্দশ ভুবন। দিবাকর- সূর্য। শশী-চাঁদ। পাঁতিপাঁতি- পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে। সিপিতে- ঝিনুকে। ভুঞ্জয়- ভাগ করে। ভাঁতি- শোভা, ভুগত- ভোগ করতে, দর্শাইতে- দেখাতে।
‘হামদ' কবিতাংশটি আলাওলের পদ্মাবতী কাব্য থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এটি পদ্মাবতী কাব্যের প্রারম্ভে মহান আল্লাহর প্রশংসাসূচক পর্বের অংশ ।
কবি এই কবিতাংশে বিশ্বসৃষ্টির রহস্য সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। কবি মহান স্রষ্টার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাঁর সৃষ্টির মহিমা বর্ণনা করেছেন। আগুন, বাতাস, পানি ও মাটি এসব উপাদান সহযোগে আল্লাহ এই বিশাল বিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। তারপর জলচরপ্রাণী, কীটপতঙ্গ, বৃক্ষলতা,পশুপাখি এবং সব শেষে সৃষ্টি করেছেন মানুষ। স্রষ্টার সৃষ্টির মধ্যে মানুষই শ্রেষ্ঠ। মানুষের উপভোগের জন্য বিচিত্র উপকরণ প্রদান করা হয়েছে। বিধাতা মানুষকে ভাগ্যের অধীন করে পার্থিব জীবনে সুখী কিংবা দুঃখী, গুণী কিংবা নির্গুণ করে পাঠিয়েছেন। কবিতাংশে স্রষ্টার খেয়াল ও বিধি অনুযায়ীই যে সৃষ্টিজগত ও মানবভাগ্য নির্ধারণ হয়েছে তারই আলোকপাত বিধৃত হয়েছে ।
কিতাব পড়িতে যার নাহিক অভ্যাস ।
সে সবে কহিল মোতে মনে হাবিলাষ ॥
তে কাজে নিবেদি বাংলা করিয়া রচন।
নিজ পরিশ্রম তোষি আমি সর্বজন ৷
আরবি ফারসি শাস্ত্রে নাই কোন রাগ ।
দেশী ভাষে বুঝিতে ললাটে পুরে ভাগ ॥
আরবি ফারসি হিন্দে নাই দুই মত ।
যদি বা লিখয়ে আল্লা নবীর ছিফত ॥
যেই দেশে যেই বাক্য কহে নরগণ ।
সেই বাক্য বুঝে প্রভু আপে নিরঞ্জন ॥
সর্ববাক্য বুঝে প্রভু কিবা হিন্দুয়ানী ।
বঙ্গদেশী বাক্য কিবা যত ইতি বাণী ॥
মারফত ভেদে যার নাহিক গমন ।
হিন্দুর অক্ষরে হিংসে সে সবের গণ ॥
যে সবে বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী ।
সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি ॥
দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায় ।
নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায় ॥
মাতা পিতামহ ক্রমে বঙ্গেত বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি ॥
আনুমানিক ১৬২০ খ্রিষ্টাব্দে সন্দ্বীপের সুধারামপুর গ্রামে আবদুল হাকিম জন্মগ্রহণ করেন। মধ্যযুগের অন্যতম প্রধান কবি আবদুল হাকিমের স্বদেশের ও স্বভাষার প্রতি ছিল অটুট ও অপরিসীম প্রেম। সেই যুগে মাতৃভাষার প্রতি এমন গভীর ভালোবাসার নিদর্শন ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কালজয়ী আদর্শ। নূরনামা তাঁর বিখ্যাত কাব্য। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্য হলো : ইউসুফ জোলেখা, লালমতি, সয়ফুলমুলক, শিহাবুদ্দিননামা, নসীহত্থামা, কারবালা ও শহরনামা। তাঁর কবিতায় অনুপম ব্যক্তিত্বের পরিচয় মেলে। তিনি ১৬৯০ সালে মৃত্যুবরণ করেন ।
হাবিলাষ- অভিলাষ, প্রবল ইচ্ছা। ছিফত- গুণ। নিরঞ্জন- নির্মল (এখানে সৃষ্টিকর্তা, আল্লাহ)।বঙ্গবাণী- বাংলা ভাষা। মারফত - মরমি সাধনা, আল্লাহকে সম্যকভাবে জানার জন্য সাধনা। জুয়ায়- যোগায় । ভাগ- ভাগ্য। দেশী ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়- এই কবিতাটি সপ্তদশ শতকে রচিত । তৎকালেও এক শ্রেণির লোক নিজের দেশ, নিজের ভাষা, নিজের সংস্কৃতি, এমন কি নিজের আসল পরিচয় সম্পর্কেও ছিল বিভ্রান্ত এবং সংকীর্ণচেতা। শিকড়হীন পরগাছা স্বভাবের এসব লোকের প্রতি কবি তীব্র ক্ষোভে বলিষ্ঠ বাণী উচ্চারণ করে বলেছেন, “নিজ দেশ তেয়াগী কেন বিদেশ ন যায়'। আপে- স্বয়ং, আপনি ৷
‘বঙ্গবাণী' কবিতাটি কবি আবদুল হাকিমের নূরনামা কাব্য থেকে সংকলন করা হয়েছে। মধ্যযুগীয় পরিবেশে বঙ্গভাষী এবং বঙ্গভাষার প্রতি এমন বলিষ্ট বাণীবদ্ধ কবিতার নিদর্শন দুর্লভ ।
কবি এই কবিতায় তাঁর গভীর উপলব্ধি ও বিশ্বাসের কথা নির্দ্বিধায় ব্যক্ত করেছেন। আরবি ফারসি ভাষার প্রতি কবির মোটেই বিদ্বেষ নেই। এ সব ভাষায় আল্লাহ ও মহানবীর স্তুতি বর্ণিত হয়েছে। তাই এসব ভাষার প্রতি সবাই পরম শ্রদ্ধাশীল। যে ভাষা জনসাধারণের বোধগম্য নয়, যে ভাষায় অন্যের সঙ্গে ভাববিনিময় করা যায় না সে সব ভাষাভাষী লোকের পক্ষে মাতৃভাষায় কথা বলা বা লেখাই একমাত্র পন্থা। এই কারণেই কবি মাতৃভাষায় গ্রন্থ রচনায় মনোনিবেশ করেছেন। কবির মতে, মানুষ মাত্রেই নিজ ভাষায় স্রষ্টাকে ডাকে আর স্রষ্টাও মানুষের বক্তব্য বুঝতে পারেন। কবির চিত্তে তীব্র ক্ষোভ এজন্য যে, যারা বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করেছে, অথচ বাংলা ভাষার প্রতি তাদের মমতা নেই, তাদের বংশ ও জন্মপরিচয় সম্পর্কে কবির মনে সন্দেহ জাগে। কবি সখেদে বলেছেন, এ সব লোক, যাদের মনে স্বদেশের ও স্বভাষার প্রতি কিছুমাত্র অনুরাগ নেই তারা কেন এদেশ পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায় না! বংশানুক্রমে বাংলাদেশেই আমাদের বসতি, বাংলাদেশ আমাদের মাতৃভূমি এবং মাতৃভাষা বাংলায় বর্ণিত বক্তব্য আমাদের মর্ম স্পর্শ করে । এই ভাষার চেয়ে হিতকর আর কী হতে পারে । কবিতায় মাতৃভাষার প্রতি প্রেম ও অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের পরিচয় ফুটে উঠেছে।
সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে !
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;
সতত (যেমতি লোক নিশার স্বপনে
শোনে মায়া-মন্ত্রধ্বনি) তব কলকলে
জুড়াই এ কান আমি ভ্রান্তির ছলনে !
বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?
দুগ্ধ-স্রোতোরূপী তুমি জন্মভূমি-স্তনে ।
আর কি হে হবে দেখা? - যত দিন যাবে,
প্রজারূপে রাজরূপ সাগরেরে দিতে
বারি-রূপ কর তুমি; এ মিনতি, গাবে
বঙ্গজ জনের কানে, সখে, সখা-রীতে
নাম তার, এ প্রবাসে মজি প্রেম-ভাবে
লইছে যে নাম তব বঙ্গের সংগীতে।
মধুসূদন দত্ত ১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে জানুয়ারি যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। স্কুলজীবনের শেষে তিনি কলকাতার হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজে অধ্যয়নকালে ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি তাঁর তীব্র অনুরাগ জন্মে। ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হন। তখন তাঁর নামের প্রথমে যোগ হয় 'মাইকেল'। পাশ্চাত্য জীবনযাপনের প্রতি প্রবল আগ্রহ এবং ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি তীব্র আবেগ তাঁকে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্যরচনায় উদ্বুদ্ধ করে। পরবর্তীকালে জীবনের বিচিত্র কষ্টকর অভিজ্ঞতায় তাঁর এই ভুল ভেঙেছিল । বাংলা ভাষায় কাব্যরচনার মধ্য দিয়ে তাঁর কবিপ্রতিভার যথার্থ স্ফূর্তি ঘটে। তাঁর অমর কীর্তি 'মেঘনাদ বধ কাব্য'। তাঁর অন্যান্য কাব্য : তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য, বীরাঙ্গনা কাব্য, ব্রজাঙ্গনা কাব্য ও চতুর্দশপদী কবিতাবলী। তাঁর নাটক : কৃষ্ণকুমারী, শর্মিষ্ঠা, পদ্মাবতী; এবং প্রহসন : একেই কি বলে সভ্যতা ও বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ। বাংলা কাব্যে অমিত্রাক্ষর ছন্দ এবং সনেট প্রবর্তন করে তিনি যোগ করেছেন নতুন মাত্রা । ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে জুন কবি পরলোকগমন করেন ।
সতত-সর্বদা। বিরলে-একান্ত নিরিবিলিতে। নিশা-রাত্রি। ভ্রান্তি-ভুল। বারি-রূপকর- প্রজা যেমন রাজাকে কর বা রাজস্ব দেয়, তেমনি কপোতাক্ষ নদও সাগরকে জলরূপ কর বা রাজস্ব দিচ্ছে। চতুর্দশপদী কবিতা- ইংরেজিতে Sonnet, বাংলায় চতুর্দশপদী কবিতা। চৌদ্দ-চরণ- সমন্বিত ভাবসংহত সুনির্দিষ্ট। চতুর্দশপদী কবিতার প্রথম আট চরণের স্তবককে অষ্টক (Octave) এবং পরবর্তী ছয় চরণের স্তবককে ষষ্টক (Sestet) বলে। অষ্টকে মূলত ভাবের প্রবর্তনা এবং ষটক ভাবের পরিণতি থাকে । চতুর্দশপদী কবিতায় কয়েক প্রকার অন্ত্যমিল প্রচলিত আছে। যেমন, প্রথম আট চরণ : কখখক কখখক। শেষ ছয় চরণ : ঘঙচ ঘঙচ । অথবা প্রথম আট চরণ : কখখগ কখখগ, শেষ ছয় চরণ : ঘঙঘঙ চচ। ‘কপোতাক্ষ নদ' একটি চতুর্দশপদী কবিতা। এখানে মিলবিন্যাস : কখকখ কখখক গখগ ঘগঘ ৷
‘কপোতাক্ষ নদ' কবিতাটি কবির চতুর্দশপদী কবিতাবলী থেকে গৃহীত হয়েছে। এই কবিতায় কবির স্মৃতিকাতরতার আবরণে তাঁর অত্যুজ্জ্বল দেশপ্রেম প্রকাশিত হয়েছে। কবি যশোর জেলার কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে মধুসূদন এই নদের তীরে প্রাকৃতিক পরিবেশে বড় হয়েছেন। যখন তিনি ফ্রান্সে বসবাস করেন, তখন জন্মভূমির শৈশব-কৈশোরের বেদনা-বিধুর স্মৃতি তাঁর মনে জাগিয়েছে কাতরতা। দূরে বসেও তিনি যেন কপোতাক্ষ নদের কলকল ধ্বনি শুনতে পান। কত দেশে কত নদ-নদী তিনি দেখেছেন, কিন্তু জন্মভূমির এই নদ যেন মায়ের স্নেহডোরে তাঁকে বেঁধেছে, কিছুতেই তিনি তাকে ভুলতে পারেন না। কবির মনে সন্দেহ জাগে, আর কি তিনি এই নদের দেখা পাবেন ! কপোতাক্ষ নদের কাছে তাঁর সবিনয় মিনতি-বন্ধুভাবে তাকে তিনি স্নেহাদরে যেমন স্মরণ করেন, কপোতাক্ষও যেন একই প্রেমভাবে তাঁকে সস্নেহে স্মরণ করে । কপোতাক্ষ নদ যেন তার স্বদেশের জন্য হৃদয়ের কাতরতা বঙ্গবাসীদের নিকট ব্যক্ত করে । দেশমাতৃকার প্রতি অকুণ্ঠ প্রেম যে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি কবিতায় তাই ধরা পড়েছে।
বলো না কাতর স্বরে বৃথা জন্ম এ সংসারে
এ জীবন নিশার স্বপন,
দারা পুত্র পরিবার তুমি কার কে তোমার
বলে জীব করো না ক্ৰন্দন;
মানব-জনম সার, এমন পাবে না আর
বাহ্যদৃশ্যে ভুলো না রে মন;
কর যত্ন হবে জয়, জীবাত্মা অনিত্য নয়
ওহে জীব কর আকিঞ্চন ।
করো না সুখের আশ, পরো না দুখের ফাঁস
জীবনের উদ্দেশ্য তা নয়,
সংসারে সংসারী সাজ, করো নিত্য নিজ কাজ,
ভবের উন্নতি যাতে হয় ।
দিন যায় ক্ষণ যায়, সময় কাহারো নয়,
বেগে ধায় নাহি রহে স্থির,
সহায় সম্পদ বল, সকলি ঘুচায় কাল,
আয়ু যেন শৈবালের নীর ।
সংসার-সমরাঙ্গনে যুদ্ধ কর দৃঢ়পণে,
ভয়ে ভীত হইও না মানব;
কর যুদ্ধ বীর্যবান, যায় যাবে যাক প্ৰাণ
মহিমাই জগতে দুর্লভ।
মনোহর মূর্তি হেরে, ওহে জীব অন্ধকারে,
ভবিষ্যতে করো না নির্ভর
অতীত সুখের দিনে, পুনঃ আর ডেকে এনে,
চিন্তা করে হইও না কাতর ।
মহাজ্ঞানী মহাজন, যে পথে করে গমন,
হয়েছেন প্রাতঃস্মরণীয়,
সেই পথ লক্ষ্য করে স্বীয় কীর্তি ধ্বজা ধরে
আমরাও হব বরণীয়
সমর-সাগর-তীরে, পদাঙ্ক অঙ্কিত করে
আমরাও হব হে অমর;
সেই চিহ্ন লক্ষ করে, অন্য কোনো জন পরে,
যশোদ্বারে আসিবে সত্বর ।
করো না মানবগণ, বৃথা ক্ষয় এ জীবন,
সংসার-সমরাঙ্গন মাঝে;
সঙ্কল্প করেছ যাহা, সাধন করহ তাহা,
রত হয়ে নিজ নিজ কাজে ।
হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৩৮ সালের ১৭ই এপ্রিল হুগলি জেলার গুলিটা রাজবল্লভহাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কৈলাশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার খিদিরপুর বাংলা স্কুলে পড়াশোনাকালে আর্থিক সংকটে পড়েন। ফলে তাঁর পড়াশোনা তখন বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর কলকাতা সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারীর আশ্রয়ে তিনি ইংরেজি শেখেন। পরবর্তীকালে হিন্দু কলেজে সিনিয়র স্কুল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে তিনি ১৮৫৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি সরকারি চাকরি, স্কুল-শিক্ষকতা এবং পরিশেষে আইন ব্যবসায় নিয়োজিত হন। মাইকেল মধুসূদন দত্তের পরে কাব্য রচনায় তিনিই ছিলেন সবচেয়ে খ্যাতিমান । স্বদেশপ্রেমের অনুপ্রেরণায় তিনি বৃত্রসংহার নামক মহাকাব্য রচনা করেন। এছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্য : চিন্তাতরঙ্গিনী, বীরবাহু, আশাকানন, ছায়াময়ী ইত্যাদি। ২৪শে মে ১৯০৩ সালে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মৃত্যুবরণ করেন ।
কাতর স্বরে- দুর্বল কণ্ঠে, করুণভাবে। দারা - স্ত্রী। বাহ্যদৃশ্যে- বাইরের জগতের চাকচিক্যময় রূপে বা জিনিসে। জীবাত্মা – মানুষের আত্মা, আত্মা যদিও অমর, কিন্তু মানুষের মৃত্যু অনিবার্য, কাজেই দেহ ছেড়ে আত্মা একদিন চলে যাবে, চিরকাল দেহকে আঁকড়ে থাকতে পারবে না। অনিত্য – অস্থায়ী, যা চিরকালের নয়। আকিঞ্চন – চেষ্টা, আকাঙ্ক্ষা; আশ – আশা। ভবের -জগতের, সংসারের। সমরাঙ্গনে – যুদ্ধক্ষেত্রে (কবি মানুষের জীবনকে যুদ্ধক্ষেত্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন)। বীর্যবান – শক্তিমান। মহিমা — গৌরব। প্রাতঃস্মরণীয় – সকাল বেলায় স্মরণ করার যোগ্য, অর্থাৎ সকলের শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র। ধ্বজা – পতাকা, নিশান। বরণীয় – সম্মানের যোগ্য। সংসারে-সমরাঙ্গনে – যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসী সৈনিকের মতো সংসারেও নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মোকাবেলা করে বেঁচে থাকতে হবে। স্বপন – রাতের স্বপ্নের মতোই মিথ্যা বা অসার। আয়ু যেন শৈবালের নীর - শেওলার ওপর পানির ফোঁটার মতো ক্ষণস্থায়ী। স্বীয় – নিজ, আপন। পদাঙ্ক – কোনো মহৎ ব্যক্তির কৃতকর্ম বা চরিত্র । যশোদ্বারে – খ্যাতির দ্বারে ।
জীবন কেবল নিছক স্বপ্ন নয়। কাজেই এ পৃথিবীকে শুধু স্বপ্ন ও মায়ার জগৎ বলা যায় না। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা এবং পরিজনবর্গ কেউ কারও নয়, একথাও ঠিক নয়। মানব- জন্ম অত্যন্ত মূল্যবান। মিথ্যা সুখের কল্পনা করে দুঃখ বাড়িয়ে লাভ নেই তা আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যও নয়। সংসারে বাস করতে হলে সংসারের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। কেননা বৈরাগ্যে মুক্তি নেই । আমাদের জীবন যেন শৈবালের শিশিরবিন্দুর মতো ক্ষণস্থায়ী। সুতরাং মানুষকে এ পৃথিবীতে সাহসী যোদ্ধার মতো সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হবে। মহাজ্ঞানী ও মহান ব্যক্তিদের পথ অনুসরণ করে আমাদেরও বরণীয় হতে হবে। কেননা জীবন তো একবারই। নেতিবাচকতা পরিহারপূর্বক মহামানবের পদচিহ্ন অনুসরণ করে জীবনপাঠের দীক্ষা গ্রহণের কথা কবিতাটিতে প্রকাশিত হয়েছে। 'জীবন সঙ্গীত' কবিতাটি মার্কিন কবি 'Henry Wadsworth Longfellow'- (১৮০৭-১৮৮২) এর ‘A Psalm of life' শীর্ষক ইংরেজি কবিতার ভাবানুবাদ ।
মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই ।
এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে
জীবন্ত হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই !
ধরায় প্রাণের খেলা চিরতরঙ্গিত,
বিরহ মিলন কত হাসি-অশ্রু-ময়-
মানবের সুখে দুঃখে গাঁথিয়া সংগীত
যদি গো রচিতে পারি অমর-আলয় !
তা যদি না পারি, তবে বাঁচি যত কাল
তোমাদেরি মাঝখানে লভি যেন ঠাঁই,
তোমরা তুলিবে বলে সকাল বিকাল
নব নব সংগীতের কুসুম ফুটাই ।
হাসি মুখে নিয়ো ফুল, তার পরে হায়
ফেলে দিয়ো ফুল, যদি সে ফুল শুকায় ॥
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২৫শে বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দে (৭ই মে ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ) কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। বাল্যকালে রবীন্দ্রনাথকে ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্মাল স্কুল, বেঙ্গল একাডেমি প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার জন্য পাঠানো হলেও তিনি বেশিদিন স্কুলের শাসনে থাকতে পারেননি । এমনকি সতেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথকে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য ইংল্যান্ডে পাঠানো হলেও দেড় বছর পরে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে তিনি দেশে ফিরে আসেন। বিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা তিনি লাভ করেননি, কিন্তু সাহিত্যের বিচিত্র ক্ষেত্রে তাঁর পদচারণা এক বিস্ময়ের বস্তু । তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই অসামান্য প্রতিভাধর । বাল্যেই তাঁর কবিপ্রতিভার উন্মেষ ঘটে। মাত্র পনেরো বছর বয়সে তাঁর বনফুল কাব্য প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি কাব্যের জন্য এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বস্তুত তাঁর একক সাধনায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সকল শাখায় দ্রুত উন্নতি লাভ করে এবং বিশ্বদরবারে গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি একাধারে সাহিত্যিক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্য প্রযোজক ও অভিনেতা । কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান ইত্যাদি সাহিত্যের সকল শাখাই তাঁর অবদানে সমৃদ্ধ । তাঁর অজস্র রচনার মধ্যে মানসী, সোনার তরী, চিত্রা, কল্পনা, ক্ষণিকা, বলাকা, পুনশ্চ, চোখের বালি, গোরা, ঘরে বাইরে, যোগাযোগ, শেষের কবিতা, বিসর্জন, ডাকঘর, রক্তকরবী, গল্পগুচ্ছ, বিচিত্র প্রবন্ধ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ২২শে শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে (৭ই আগস্ট ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ) কলকাতায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ।
সূর্য করে - সূর্যের কিরণে। চিরতরঙ্গিত – সর্বদা কল্লোলিত, বহমান। লভি – লাভ করি। জীবন্ত হৃদয় মাঝে- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর রচনায় মানুষের মাঝে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন । আলোচ্য অংশে তাঁর এই আকাঙ্ক্ষার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। বিরহমিলন ... অশ্রুময়- মানুষের জীবন কুসুমাস্তীর্ণ নয়। হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা নিয়ে তার জীবন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানব জীবনের এই বৈচিত্র্যের মধ্যে স্থান করে নিতে চেয়েছেন। আর তার সৃষ্টির মধ্যে ফলিয়ে তুলতে চেয়েছেন যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার বিপুল এক আখ্যান। অমর আলয় -অমর সৃষ্টি অর্থে। নব নব সঙ্গীতের কুসুম ফুটাই – রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির জগৎ বিপুল। মানুষের জীবনের বিচিত্র অনুভব-অনুভূতি, ভাব-ভাবনা ও কর্মের জগৎকে তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্যে প্রাণময় করে তুলতে চেয়েছেন। তাঁর সেই সৃষ্টির মধ্য থেকে রূপ-রস-গন্ধ যেন মানুষ অনুভব করতে পারে, তার জন্য তিনি প্রতিনিয়ত ফুটিয়ে তুলছেন সৃষ্টির কুসুম ।
কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কড়ি ও কোমল কাব্যগ্রন্থ থেকে সংকলিত হয়েছে। এই জগৎ সুন্দর এবং আকর্ষণীয়। মানুষের হাসি-কান্না, মান-অভিমান, আবেগ-ভালোবাসায় পৃথিবী পরিপূর্ণ। জগতের মায়া ত্যাগ করে অন্য কিছুর আহ্বানে প্রলুব্ধ হয়ে কবি তাই মৃত্যুবরণ করতে চান না। তিনি অভিলাষ ব্যক্ত করেছেন, মানুষের মনজয়ী রচনা সৃজনের মাধ্যমে সবার কাছে আদৃত হওয়ার। পৃথিবীর নরনারীর সুখ-দুঃখ-বিরহ যদি ঠিকভাবে তাঁর সৃষ্টিতে ঠাঁই পায়, তবেই তিনি অমর হবেন । তা-না হলে তাঁর রচনা শুকনো ফুলের মতোই সবার কাছে অনাদৃত হয়ে পড়বে। সৎ ও শুভকর্ম করে জগতে মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার জন্য দৃঢ় সংকল্প প্রয়োজন। কবিতাটিতে এ প্রত্যয়ই প্রতিফলিত হয়েছে । জীবন তো একবারই । জীবনে নেতিবাচকতা পরিহারপূর্বক মহামানবের পদচিহ্ন অনুসরণ করে জীবনপাঠের দীক্ষা কবিতাটিতে উচ্চকিত হয়েছে।
কহিলা হবু, ‘শুন গো গোবুরায়,
কালিকে আমি ভেবেছি সারা রাত্র-
মলিন ধুলা লাগিবে কেন পায়
ধরণী -মাঝে চরণ-ফেলা মাত্র !
তোমরা শুধু বেতন লহ বাঁটি,
রাজার কাজে কিছুই নাহি দৃষ্টি ।
আমার মাটি লাগায় মোরে মাটি,
রাজ্যে মোর একি এ অনাসৃষ্টি!
শীঘ্র এর করিবে প্রতিকার,
নহিলে কারো রক্ষা নাহি আর ।'
শুনিয়া গোবু ভাবিয়া হলো খুন,
দারুণ ত্রাসে ঘর্ম বহে গাত্রে ।
পণ্ডিতের হইল মুখ চুন,
পাত্রদের নিদ্রা নাহি রাত্রে।
রান্নাঘরে নাহিকো চড়ে হাঁড়ি,
কান্নাকাটি পড়িল বাড়ি—মধ্যে,
অশ্রুজলে ভাসায়ে পাকা দাড়ি
কহিলা গোবু হবুর পাদপদ্মে,
'যদি না ধুলা লাগিবে তব পায়ে,
পায়ের ধুলা পাইব কী উপায়ে!'
শুনিয়া রাজা ভাবিল দুলি দুলি,
কহিল শেষে, ‘কথাটা বটে সত্য-
কিন্তু আগে বিদায় করো ধূলি,
ভাবিয়ো পরে পদধুলির তত্ত্ব।
ধুলা-অভাবে না পেলে পদধুলা
তোমরা সবে মাহিনা খাও মিথ্যে,
কেন-বা তবে পুষিনু এতগুলা
উপাধি-ধরা বৈজ্ঞানিক ভৃত্যে?
আগের কাজ আগে তো তুমি সারো,
পরের কথা ভাবিয়ো পরে আরো।'
আঁধার দেখে রাজার কথা শুনি,
যতনভরে আনিল তবে মন্ত্ৰী
যেখানে যত আছিল জ্ঞানী গুণী
দেশে বিদেশে যতেক ছিল যন্ত্রী ।
বসিল সবে চশমা চোখে আঁটি,
ফুরায়ে গেল উনিশ পিপে নস্য,
অনেক ভেবে কহিল, ‘গেলে মাটি
ধরায় তবে কোথায় হবে শস্য?'
কহিল রাজা, ‘তাই যদি না হবে,
পণ্ডিতেরা রয়েছ কেন তবে?'
সকলে মিলি যুক্তি করি শেষে
কিনিল ঝাঁটা সাড়ে-সতেরো লক্ষ,
ঝাঁটের চোটে পথের ধুলা এসে
ভরিয়া দিল রাজার মুখ বক্ষ ৷
ধুলায় কেহ মেলিতে নারে চোখ,
ধুলার মেঘে পড়িল ঢাকা সূৰ্য,
ধুলার বেগে কাশিয়া মরে লোক,
ধুলার মাঝে নগর হলো উহ্য।
কহিল রাজা, “করিতে ধুলা দূর,
জগৎ হলো ধুলায় ভরপুর!”
তখন বেগে ছুটিল ঝাঁকে-ঝাঁক
মশক কাঁখে একুশ লাখ ভিস্তি ।
পুকুরে বিলে রহিল শুধু পাঁক,
নদীর জলে নাহিকো চলে কিস্তি ।
জলের জীব মরিল জল বিনা,
ডাঙার প্রাণী সাঁতার করে চেষ্টা।
পাঁকের তলে মজিল বেচা-কিনা,
সর্দিজ্বরে উজাড় হলো দেশটা ।
কহিল রাজা, ‘এমনি সব গাধা
ধুলারে মারি করিয়া দিল কাদা!”
আবার সবে ডাকিল পরামর্শে,
বসিল পুনঃ যতেক গুণবন্ত-
ঘুরিয়া মাথা হেরিল চোখে সর্ষে,
ধুলার হায় নাহিক পায় অন্ত ।
কহিল, “মহী মাদুর দিয়ে ঢাকো,
ফরাস পাতি করিব ধুলা বন্ধ ।
' কহিল কেহ, ‘রাজারে ঘরে রাখো,
কোথাও যেন থাকে না কোনো রন্ধ্র !
ধুলার মাঝে না যদি দেন পা
তা হলে পায়ে ধুলা তো লাগে না ।’
কহিল রাজা, ‘সে কথা বড়ো খাঁটি -
কিন্তু মোর হতেছে মনে সন্ধ,
মাটির ভয়ে রাজ্য হবে মাটি
দিবস-রাতি রহিলে আমি বন্ধ।'
কহিল সবে, ‘চামারে তবে ডাকি
চর্ম দিয়া মুড়িয়া দাও পৃথ্বী ।
ধূলির মহী ঝুলির মাঝে ঢাকি
মহীপতির রহিবে মহাকীর্তি ।’
কহিল সবে, ‘হবে সে অবহেলে,
যোগ্যমতো চামার যদি মেলে।'
রাজার চর ধাইল হেথা-হোথা,
ছুটিল সবে ছাড়িয়া সব কর্ম ।
যোগ্যমতো চামার নাহি কোথা,
না মিলে এত উচিত-মতো চর্ম ।
তখন ধীরে চামার-কুলপতি
কহিল এসে ঈষৎ হেসে বৃদ্ধ,
“বলিতে পারি করিলে অনুমতি,
সহজে যাহে মানস হবে সিদ্ধ ।
নিজের দুটি চরণ ঢাকো, তবে
ধরণী আর ঢাকিতে নাহি হবে।'
কহিল রাজা, ‘এত কি হবে সিধে !
ভাবিয়া ম'ল সকল দেশসুদ্ধ !”
মন্ত্রী কহে,'বেটারে শূল বিঁধে
কারার মাঝে করিয়া রাখো রুদ্ধ।'
রাজার পদ চরম- আবরণে
ঢাকিল বুড়া বসিয়া পদোপান্তে।
মন্ত্রী কহে,'আমারো ছিল মনে
কেমনে বেটা পেরেছে সেটা জানতে।'
সেদিন হতে চলিল জুতা পরা-
বাঁচিল গোবু, রক্ষা পেল ধরা ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২৫শে বৈশাখ ১২৬৮ বঙ্গাব্দে (৭ই মে ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ) কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। বাল্যকালে রবীন্দ্রনাথকে ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্মাল স্কুল, বেঙ্গল একাডেমি প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার জন্য পাঠানো হলেও তিনি বেশিদিন স্কুলের শাসনে থাকতে পারেননি । এমনকি সতেরো বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথকে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য ইংল্যান্ডে পাঠানো হলেও দেড় বছর পরে পড়াশোনা অসমাপ্ত রেখে তিনি দেশে ফিরে আসেন। বিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা তিনি লাভ করেননি, কিন্তু সাহিত্যের বিচিত্র ক্ষেত্রে তাঁর পদচারণা এক বিস্ময়ের বস্তু । তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই অসামান্য প্রতিভাধর । বাল্যেই তাঁর কবিপ্রতিভার উন্মেষ ঘটে। মাত্র পনেরো বছর বয়সে তাঁর বনফুল কাব্য প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি কাব্যের জন্য এশীয়দের মধ্যে প্রথম সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। বস্তুত তাঁর একক সাধনায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সকল শাখায় দ্রুত উন্নতি লাভ করে এবং বিশ্বদরবারে গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি একাধারে সাহিত্যিক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্য প্রযোজক ও অভিনেতা । কাব্য, ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান ইত্যাদি সাহিত্যের সকল শাখাই তাঁর অবদানে সমৃদ্ধ । তাঁর অজস্র রচনার মধ্যে মানসী, সোনার তরী, চিত্রা, কল্পনা, ক্ষণিকা, বলাকা, পুনশ্চ, চোখের বালি, গোরা, ঘরে বাইরে, যোগাযোগ, শেষের কবিতা, বিসর্জন, ডাকঘর, রক্তকরবী, গল্পগুচ্ছ, বিচিত্র প্রবন্ধ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ২২শে শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে (৭ই আগস্ট ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ) কলকাতায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ।
চরণ – পা। প্রতিকার – প্রতিবিধান, সমাধান। মাহিনা - পারিশ্রমিক, বেতন। পুষি- পোষণ করি, লালন-পালন করি। পিপে— ঢাক বা ঢোলের আকৃতিবিশিষ্ট কাঠের তৈরি পাত্র। ভিত্তি - পানি বহনের জন্য চামড়ার তৈরি এক প্রকার থলি। পাঁক – কাদা, কদম৷ কিস্তি – নৌকা বা জাহাজ, জলযান। গুণবস্তু – গুণবান, গুণী। মহী – পৃথিবী, ধরণী। ফরাশ – মেঝে বা তক্তপোশে বিছানোর জন্য কার্পেট বা বিছানা, মাদুর। রন্ধ্র - ছিদ্র, ফুটো। চামার – চর্মকার, মুচি। যোগ্যমতো – উপযুক্ত। - কুলপতি – বংশের প্রধান, কুলশ্রেষ্ঠ ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কল্পনা কাব্য থেকে ‘জুতা আবিষ্কার' কবিতাটি সংকলন করা হয়েছে। ধুলাবালি থেকে রাজার পা দুটিকে মুক্ত রাখার নানা প্রসঙ্গই কবিতাটির মূল উপজীব্য । রাজা তাঁর মন্ত্রীদের রাজ্য থেকে ধুলাবালি দূর করার নির্দেশ দেন। মন্ত্রীরা রাজ্যের ধুলাবালি ঝাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং এতে রাজ্য ধুলোয় পরিপূর্ণ হয়ে যায় । রাজার আদেশ মানতে গিয়ে রাজ্যের সভাসদ কোনো উপায় যেন খুঁজে আর পান না। অবশেষে রাজ্যেরই এক বয়স্ক চর্মকার নিজ বুদ্ধিতে রাজার পদযুগল চামড়া দিয়ে ঢেকে দেয়। এভাবে রাজার পা ধুলার স্পর্শ থেকে মুক্তি পায়। সাধারণ সমস্যার সমাধান সাধারণ বুদ্ধিতেই করতে হয়। জটিলভাবে করতে গেলে বিড়ম্বনাই বাড়ে। সমস্যা সমাধানে পদস্থ জনই যে অনিবার্য তাও নয়। সাধারণের দ্বারাও অসাধারণ কৃত্য সম্পাদিত হতে পারে । কবিতায় তাই মূর্ত হয়ে উঠেছে।
পায়ের তলায় নরম ঠেকল কী!
আস্তে একটু চল না ঠাকুরঝি –
ওমা, এ যে ঝরা-বকুল ! নয়?
তাইতো বলি, বসে দোরের পাশে,
রাত্তিরে কাল— মধুমদির বাসে
আকাশ-পাতাল— কতই মনে হয়।
জ্যৈষ্ঠ আসতে ক-দিন দেরি ভাই -
আমের গায়ে বরণ দেখা যায়?
অনেক দেরি? কেমন করে হবে!
কোকিল-ডাকা শুনেছি সেই কবে,
দখিন হাওয়া – বন্ধ কবে ভাই;
দীঘির ঘাটে নতুন সিঁড়ি জাগে -
শ্যাওলা-পিছল – এমনি শঙ্কা লাগে,
পা-পিছলিয়ে তলিয়ে যদি যাই!
মন্দ নেহাত হয় না কিন্তু তায়-
অন্ধ চোখের দ্বন্দ্ব চুকে যায় !
দুঃখ নাইকো সত্যি কথা শোন,
অন্ধ গেলে কী আর হবে বোন?
বাঁচবি তোরা – দাদা তো তোর আগে?
এই আষাঢ়েই আবার বিয়ে হবে,
বাড়ি আসার পথ খুঁজে না পাবে -
দেখবি তখন - প্রবাস কেমন লাগে?
‘চোখ গেল’ ওই চেঁচিয়ে হলো সারা ।
আচ্ছা দিদি, কী করবে ভাই তারা-
জন্ম লাগি গিয়েছে যার চোখ !
কাঁদার সুখ যে বারণ তাহার – ছাই!
কাঁদতে পেলে বাঁচত সে যে ভাই,
কতক তবু কমত যে তার শোক ।
‘চোখ গেল’— তার ভরসা তবু আছে—
চক্ষুহীনার কী কথা কার কাছে!
টানিস কেন? কিসের তাড়াতাড়ি-
সেই তো ফিরে যাব আবার বাড়ি,
একলা-থাকা- সেই তো গৃহকোণ—
তার চেয়ে এই স্নিগ্ধ শীতল জলে
দুটো যেন প্রাণের কথা বলে—
দরদ-ভরা দুখের আলাপন;
পরশ তাহার মায়ের স্নেহের মতো
ভুলায় খানিক মনের ব্যথা যত!
যতীন্দ্রমোহন বাগচীর জন্ম ১৮৭৮ সালের ২৭শে নভেম্বর নদীয়া জেলার জামশেদপুর গ্রামে । পল্লি-প্রীতি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর কবিমানসের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও জীবনানন্দ দাশের রচনার মতো তাঁর কবিতাও নিসর্গ-সৌন্দর্যে চিত্ররূপময়। রচনায় গ্রামবাংলার শ্যামল স্নিগ্ধ রূপ উন্মোচনে তিনি প্রয়াসী হয়েছেন। গ্রাম-জীবনের অতি সাধারণ বিষয় ও সুখ-দুঃখ তিনি সহজ-সরল ভাষায় সহৃদয়তার সঙ্গে তাৎপর্যমণ্ডিত করে প্রকাশ করেছেন। তাঁর কাব্যগ্রন্থসমূহের মধ্যে আছে : লেখা, রেখা, অপরাজিতা, নাগকেশর, বন্ধুর দান, জাগরণী, নীহারিকা ও মহাভারতী। ১লা ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
ঠাকুরঝি – ননদ, স্বামীর বোন, শ্বশুরকন্যা। মধুমদির বাসে মধুর গন্ধে মোহময় - সুগন্ধে আচ্ছন্ন। আকাশ-পাতাল - নানা বিষয়, নানান ভাবনা-অনুভাবনা অর্থে ব্যবহৃত। জ্যৈষ্ঠ আসতে ক-দিন দেরি ভাই- একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের অনুভবের অসাধারণ এক জগৎ আলোচ্য অংশে ব্যক্ত হয়েছে। প্রকৃতির বিচিত্র রঙের ধারণা ও অনুভবে এই অন্ধবধূ সমৃদ্ধ। সেই জ্ঞান ও অনুভব থেকে সে জেনে নিতে চায় ঋতুর বিবর্তন। অন্ধ চোখের দ্বন্দ্ব চুকে যাক -অন্ধবধূ অনুভবঋদ্ধ মানুষ অর্থাৎ তার অনুভূতি শক্তি প্রখর। আত্মমর্যাদা বোধেও সে সমৃদ্ধ। কিন্তু সে অন্ধ । এই অন্ধত্বের কষ্ট সে গভীরভাবে অনুভব করে। দীঘির ঘাটে যখন শেওলা পড়া পিছল সিঁড়ি জাগে, তখন সে পিছল খেয়ে জলে পড়ে ডুবে মরার আশঙ্কা প্রকাশ করে। সে এও অনুভব করে যে, ডুবে মরলে অন্ধত্বের অভিশাপ ঘুচত। কিন্তু কবিতাটির চেতনা থেকে মনে হয়, অন্ধবধূ নৈরাশ্যবাদী মানুষ নয়। জীবনের প্রতি তার গভীর মমত্ববোধ আছে। চোখ গেল – পাখি বিশেষ। এই পাখির ডাক ‘চোখ গেল' শব্দের মতো মনে হয়। কাঁদার সুখ -মানুষ দুঃখে কাঁদে, শোকে কাঁদে। কিন্তু কান্নার মধ্য দিয়ে তার দুঃখ-শোকের লাঘব ঘটে।
সমাজ দৃষ্টিহীনদের অবজ্ঞা করে। দৃষ্টিহীনেরা নিজেরাও নিজেদের অসহায় ভাবে। কিন্তু ইন্দ্ৰিয়সচেতনতা দিয়ে এই প্রতিবন্ধকতা দূর করা সম্ভব। পায়ের নিচে নরম বস্তুর অস্তিত্ব, কোকিলের ডাক শুনে নতুন ঋতুর আগমন অনুমান করা, শ্যাওলায় পা রেখে নতুন সিঁড়ি জেগে ওঠার কথা বোঝা দৃষ্টিহীন হয়েও সম্ভবপর। তাই দৃষ্টিহীন হলেই নিজেকে অসহায় না ভেবে, শুধুই ঘরের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে আপন অন্তর্দৃষ্টিকে প্রসারিত করা প্রয়োজন। বধূটি চোখে দেখতে পায় না । কিন্তু অনুভবে সে জগতের রূপ-রস-গন্ধ সম্পর্কে জ্ঞান রাখে। কবিতাটিতে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও সহমর্মিতা সংবেদনশীল ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে।
চপল পায় কেবল ধাই,
কেবল গাই পরীর গান,
পুলক মোর সকল গায়,
বিভোল মোর সকল প্ৰাণ ৷
শিথিল সব শিলার পর
চরণ থুই দোদুল মন,
দুপুর-ভোর ঝিঁঝিঁর ডাক,
ঝিমায় পথ, ঘুমায় বন ।
বিজন দেশ, কূজন নাই
নিজের পায় বাজাই তাল,
একলা গাই, একলা ধাই,
দিবস রাত, সাঁঝ সকাল ।
ঝুঁকিয়ে ঘাড় ঝুম-পাহাড়
ভয় দ্যাখায়, চোখ পাকায়;
শঙ্কা নাই, সমান যাই,
টগর-ফুল-নূপুর পায়,
কোন গিরির হিম ললাট
ঘামল মোর উদ্ভবে
কোন পরীর টুট্ল হার
কোন নাচের উৎসবে।
খেয়াল নাই-নাই রে ভাই
পাই নি তার সংবাদই,
ধাই লীলায়,-খিলখিলাই
বুলবুলির বোল সাধি ।
বন-ঝাউয়ের ঝোপগুলায়
কালসারের দল চরে,
শিং শিলায়-শিলার গায়,
ডালচিনির রং ধরে ।
ঝাঁপিয়ে যাই, লাফিয়ে ধাই,
দুলিয়ে যাই অচল-ঠাঁট,
নাড়িয়ে যাই, বাড়িয়ে যাই-
টিলার গায় ডালিম-ফাট।
শালিক শুক বুলায় মুখ
থল-ঝাঁঝির মখমলে,
জরির জাল আংরাখায়
অঙ্গ মোর ঝলমলে ।
নিম্নে ধাই, শুনতে পাই
‘ফটিক জল।' হাঁকছে কে,
কণ্ঠাতেই তৃষ্ণা যার
নিক না সেই পাঁক ছেঁকে ৷
গরজ যার জল স্যাচার
পাতকুয়ায় যাক না সেই,
সুন্দরের তৃষ্ণা যার
আমরা ধাই তার আশেই ।
তার খোঁজেই বিরাম নেই
বিলাই তান-তরল শ্লোক,
চকোর চায় চন্দ্রমায়,
আমরা চাই মুগ্ধ-চোখ ।
চপল পায় কেবল ধাই
উপল-ঘায় দিই ঝিলিক,
দুল দোলাই মন ভোলাই,
ঝিলমিলাই দিগ্বিদিক।
১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার কাছাকাছি নিমতা গ্রামে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত জন্মগ্রহণ করেন। ‘তত্ত্ববোধিনী' পত্রিকার সম্পাদক ও উনিশ শতকের বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক অক্ষয়কুমার দত্ত ছিলেন তাঁর পিতামহ। সত্যেন্দ্রনাথ বি.এ. শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি কাব্যচর্চা করতেন। দর্শন, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভাষা, ধর্ম ইত্যাদি বিচিত্র বিষয়ের তিনি অনুরাগী ছিলেন। প্রাত্যহিক জীবনে প্রচুর সময় তিনি অধ্যয়ন ও কাব্যানুশীলনে ব্যয় করতেন। সবিতা, সন্ধিক্ষণ, বেণু ও বীণা, হোমশিখা, কুহু ও কেকা, অভ্র-আবীর, বেলাশেষের গান, বিদায় আরতি প্রভৃতি তাঁর মৌলিক কাব্য। তাঁর অনুবাদ- কাব্যগুলোর মধ্যে রয়েছে : তীর্থরেণু, তীর্থ-সলিল, ফুলের ফসল প্রভৃতি। বিবিধ উপনিষদ ও কবির, নানক প্রমুখের রচনা এবং আরবি, ফার্সি, চীনা, জাপানি, ইংরেজি, ফরাসি ভাষার অনেক উৎকৃষ্ট কবিতা ও গদ্য রচনা তিনি বাংলায় অনুবাদ করেন। ছন্দ নির্মাণে তিনি অসাধারণ নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। এজন্য তিনি ‘ছন্দের যাদুকর' বলে পরিচিত হন। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন ।
বিভোল— অচেতন, বিভোর, বিবশ, বিহ্বল। বিজন— নির্জন, জনশূন্য, নিভৃত। কুজন— কলরব, চিৎকার, চেঁচামেচি। ঝুম-পাহাড়— নীরব পাহাড়, নির্জন পাহাড়। হিম— তুষার, বরফ, শুক— টিয়ে পাখি। থল- স্থল। ঝাঁঝি- একপ্রকার জলজ গুল্ম, বহুদিন ধরে জমা শেওলা। মখমল- কোমল ও মিহি কাপড়। আংরাখা- লম্বা ও ঢিলা পোশাকবিশেষ। ‘ফটিক জল'- চাতক পাখি। এই পাখি ডাকলে ‘ফটিক জল' শব্দের মতো শোনা যায়। বিলাই— বিতরণ করি, পরিবেশন করি (বিলোনো থেকে)। তান- সুর। তরল শ্লোক- লঘু বা হালকা চালের কবিতা। চকোর - পাখিবিশেষ। কবি-কল্পনা অনুযায়ী এই পাখি চাঁদের আলো পান করে। চন্দ্রমা- চাঁদের আলো। উপল-ঘায়- পাথরের আঘাতে।
সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘ঝরনার গান' কবিতাটি কবির বিদায় আরতি কাব্য থেকে সংকলন করা হয়েছে। কবিতাটিতে অদ্ভুত ধ্বনিব্যঞ্জনায় প্রকাশিত হয়েছে অপূর্ব ভাব । চঞ্চল পা পুলকিত গতিময়; স্তব্ধ পাথরের বুকে আনন্দের পদচিহ্ন। নির্জন দুপুরে পাখির ডাকও শোনা যায় না। পাহাড় যেন দৈত্যের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে ভয় দেখায়! এত কিছুর মধ্যেও ঝরনার চঞ্চল ও আনন্দময় পদধ্বনিতে পর্বত থেকে নেমে আসে সাদা জলরাশির ধারা। চমৎকার এর ধ্বনিমাধুর্য ও বর্ণবৈভব। এই জলধারার যে সৌন্দর্য এবং অমিয় স্বাদ তা তুলনারহিত। গিরি থেকে পতিত এই অম্বুরাশি পাথরের বুকে আঘাত হেনে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে যে অপূর্ব সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে তা সত্যি মনোহর।
আজগুবি নয়, আজগুবি নয়, সত্যিকারের কথা
ছায়ার সাথে কুস্তি করে গাত্রে হলো ব্যথা!
ছায়া ধরার ব্যবসা করি তাও জানো না বুঝি ?
রোদের ছায়া, চাঁদের ছায়া, হরেক রকম পুঁজি।
শিশির ভেজা সদ্য ছায়া, সকাল বেলায় তাজা,
গ্রীষ্মকালে শুকনো ছায়া ভীষণ রোদে ভাজা ।
চিলগুলো যায় দুপুর বেলায় আকাশ পথে ঘুরে
ফাঁদ ফেলে তার ছায়ার উপর খাঁচায় রাখি পুরে।
কাগের ছায়া বগের ছায়া দেখছি কত ঘেঁটে -
হাল্কা মেঘের পানসে ছায়া তাও দেখেছি চেটে ।
কেউ জানে না এসব কথা কেউ বোঝে না কিছু,
কেউ ঘোরে না আমার মতো ছায়ার পিছু পিছু।
তোমরা ভাবো গাছের ছায়া অমনি লুটায় ভুঁয়ে,
অমনি শুধু ঘুমায় বুঝি শান্ত মতন শুয়ে;
আসল ব্যাপার জানবে যদি আমার কথা শোনো
বলছি যা তা সত্যি কথা, সন্দেহ নাই কোনো।
কেউ যবে তার রয় না কাছে, দেখতে নাহি পায়,
গাছের ছায়া ছটফটিয়ে এদিক ওদিক চায় ।
সেই সময়ে গুড়গুড়িয়ে পিছন হতে এসে
ধামায় চেপে ধপাস করে ধরবে তারে ঠেসে ।
পাতলা ছায়া, ফোকলা ছায়া, ছায়া গভীর কালো-
গাছের চেয়ে গাছের ছায়া সব রকমেই ভালো ৷
গাছগাছালি শেকড় বাকল সুদ্ধ সবাই গেলে,
বাপরে বলে পালায় ব্যামো ছায়ার ওষুধ খেলে ।
নিমের ছায়া ঝিঙের ছায়া তিক্ত ছায়ার পাক
যেই খাবে ভাই অঘোর ঘুমে ডাকবে তাহার নাক ।
চাঁদের আলোয় পেঁপের ছায়া ধরতে যদি পারো,
শুঁকলে পরে সর্দিকাশি থাকবে না আর কারো ।
আমড়া গাছের নোংরা ছায়া কামড়ে যদি খায়
ল্যাংড়া লোকের ঠ্যাং গজাবে সন্দেহ নাই তায় ।
আষাঢ় মাসের বাদলা দিনে বাঁচতে যদি চাও,
তেঁতুলতলার তপ্ত ছায়া হপ্তা তিনেক খাও ।
মৌয়া গাছের মিষ্টি ছায়া ‘ব্লটিং’ দিয়ে শুষে
ধুয়ে মুছে সাবধানেতে রাখছি ঘরে পুষে !
পাক্কা নতুন টাটকা ওষুধ এক্কেবারে দিশি-
দাম করেছি শস্তা বড়, চোদ্দ আনা শিশি ।
শিশু-কিশোর পাঠকদের কাছে সুকুমার রায় একটি প্রিয় নাম। তাঁর আবোল-তাবোল, হ-য-ব-র-ল প্রভৃতি অতুলনীয় রচনার জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সুকুমার রায় বিখ্যাত শিশু-সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর পুত্র এবং বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার ও শিশু সাহিত্যিক সত্যজিৎ রায়ের পিতা। সুকুমার রায়ের জন্ম ময়মনসিংহ জেলার মাশুয়া গ্রামে ১৮৮৭ সালের ৩০শে অক্টোবর। সুকুমার ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনি একদিকে বিজ্ঞান, ফটোগ্রাফি ও মুদ্রণ প্রকৌশলে উচ্চশিক্ষা নিয়েছিলেন, অন্যদিকে ছড়া রচনা ও ছবি আঁকায় মৌলিক প্রতিভা ও উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে গোড়ায় গলদ নাটকে অভিনয়ও করেছিলেন তিনি। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এক অদ্ভুত ক্লাব। নাম 'ননসেন্স ক্লাব'। এই ক্লাবের পত্রিকার নাম ছিল সাড়ে বত্রিশ ভাজা। তাঁর রচনাগুলোও অদ্ভুত ও মজাদার। হাঁসজারু, বকচ্ছপ, সিংহরিণ, হাতিমি ইত্যাদি কাল্পনিক প্রাণীর নাম তাঁরই সৃষ্টি। বিখ্যাত সন্দেশ পত্রিকাটি সম্পাদনা করেছেন সুকুমার রায়। আর একে কেন্দ্র করেই ঐ সময় সুকুমার রায়ের সাহিত্য প্রতিভা পূর্ণ বিকশিত হয়েছিল। সুকুমার রায় বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে আছেন প্রধানত খেয়াল রসের কবিতা, হাসির গল্প, নাটক ইত্যাদি শিশুতোষ রচনার জন্য। ছেলেবুড়ো সবাই তাঁর লেখা পড়ে আনন্দ পায়। সুকুমার রায়ের মৃত্যু হয় ১৯২৩ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর।
আজগুবি- অদ্ভুত, অপূর্ব, অবিশ্বাস্য, বানানো। গাত্রে — গায়ে, শরীরে। ভুঁয়ে- ভূমিতে, মাটিতে। অঘোর— অচেতন, বেহুশ। হপ্তা – সপ্তাহ মৌয়া- মহুয়া গাছ, ব্লটিং— চোষ কাগজ
সুকুমার রায়ের ‘ছায়াবাজি' ছড়া-কবিতাটি আবোল তাবোল থেকে সংকলন করা হয়েছে। তার ছড়ার অদ্ভুত জগতের মতো এখানেও অনেক আজগুবি কথা বলেছেন। যদিও তিনি বলছেন তা মোটেও আজগুবি নয়। তবুও কবির কথা বিশ্বাস হতে চায় না। সত্যি, ছায়ার সঙ্গে কি কুস্তি করা যায়? কবি বলছেন, রোদের ছায়া, চাঁদের ছায়া, বকের ছায়া, চিলের ছায়া, হাল্কা মেঘের পাসে ছায়া, শুকনো ছায়া, ভেজা ছায়া-এ রকম অসংখ্য ছায়া ধরে তিনি ব্যবসা ফেঁদেছেন। এই ছায়াবাজি বা ছায়ার ব্যবসা অবাস্তব নিশ্চয়। এই ছায়াগুলো অসুখেরও মহৌষধ! অনিদ্রা দূর করতে নিম ও ঝিঙের ছায়া; সর্দিকাশি সারাতে চাঁদের আলোয় পেঁপের ছায়া; পঙ্গু লোকের নতুন করে পা জন্মাতে আমড়ার নোংরা ছায়া যদি খাওয়া যায় তা হলে এর কোনো তুলনা নেই ! কবি তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছায়া যত্নের সঙ্গে তুলে রাখেন; কিছু সর্বসাধারণের কল্যাণার্থে নির্ধারিত মূল্যে বিতরণের জন্য রাখেন। আসলে এটি একটি রূপক কবিতা। ছায়া এখানে শিল্পের অমরাত্মা হিসেবে বিবেচিত। চটুল ভাব ও পণ্ডশ্রমের ভেতরেও যে জীবনের গভীর সত্য নিহিত থাকতে পারে কবিতায় তা-ই প্রতিভাত হয়েছে।
বাদশা বাবর কাঁদিয়া ফিরিছে, নিদ নাহি চোখে তাঁর-
পুত্র তাঁহার হুমায়ুন বুঝি বাঁচে না এবার আর!
চারিধারে তার ঘনায়ে আসিছে মরণ-অন্ধকার ।
রাজ্যের যত বিজ্ঞ হেকিম কবিরাজ দরবেশ
এসেছে সবাই, দিতেছে বসিয়া ব্যবস্থা সবিশেষ,
সেবাযত্নের বিধিবিধানের ত্রুটি নাহি এক লেশ ।
তবু তাঁর সেই দুরন্ত রোগ হটিতেছে নাক হায়,
যত দিন যায়, দুর্ভোগ তার ততই বাড়িয়া যায়-
জীবন-প্রদীপ নিভিয়া আসিছে অস্তরবির প্রায় ৷
শুধাল বাবর ব্যগ্রকণ্ঠে ভিষকবৃন্দে ডাকি,
“বল বল আজি সত্যি করিয়া, দিও নাকো মোরে ফাঁকি,
এই রোগ হতে বাদশাজাদার মুক্তি মিলিবে নাকি?'
নতমস্তকে রহিল সবাই, কহিল না কোন কথা,
মুখর হইয়া উঠিল তাঁদের সে নিষ্ঠুর নীরবতা
শেলসম আসি বাবরের বুকে বিঁধিল কিসের ব্যথা!
হেনকালে এক দরবেশ উঠি কহিলেন- ‘সুলতান,
সবচেয়ে তব শ্রেষ্ঠ যে-ধন দিতে যদি পার দান,
খুশি হয়ে তবে বাঁচাবে আল্লা বাদশাজাদার প্রাণ ।’
শুনিয়া সে কথা কহিল বাবর শঙ্কা নাহিক মানি -
‘তাই যদি হয়, প্রস্তুত আমি দিতে সেই কোরবানি,
সবচেয়ে মোর শ্রেষ্ঠ যে ধন জানি তাহা আমি জানি ।’
এতেক বলিয়া আসন পাতিয়া নিরিবিলি গৃহতল
গভীর ধেয়ানে বসিল বাবর শান্ত অচঞ্চল,
প্রার্থনারত হাতদুটি তাঁর, নয়নে অশ্রু জল।
কহিল কাঁদিয়া- ‘হে দয়াল খোদা, হে রহিম রহমান,
মোর জীবনের সবচেয়ে প্রিয় আমারি আপন প্ৰাণ,
তাই নিয়ে প্রভু পুত্রের প্রাণ কর মোরে প্রতিদান ।
স্তব্ধ-নীরব গৃহতল, মুখে নাহি কারো বাণী
গভীর রজনী, সুপ্তি-মগন নিখিল বিশ্বরাণী,
আকাশে বাতাসে ধ্বনিতেছে যেন গোপন কি কানাকানি ।
সহসা বাবর ফুকারি উঠিল - ‘নাহি ভয় নাহি ভয়,
প্রার্থনা মোর কবুল করেছে আল্লাহ যে দয়াময়,
পুত্র আমার বাঁচিয়া উঠিবে - মরিবে না নিশ্চয় ।
ঘুরিতে লাগিল পুলকে বাবর পুত্রের চারিপাশ
নিরাশ হৃদয় সে যেন আশার দৃপ্ত জয়োল্লাস,
তিমির রাতের তোরণে তোরণে উষার পূর্বাভাস ।
সেইদিন হতে রোগ-লক্ষণ দেখাদিল বাবরের,
হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করিল শয্যা সে মরণের,
নতুন জীবনে হুমায়ুন ধীরে বাঁচিয়া উঠিল ফের।
মরিল বাবর - না, না ভুল কথা, মৃত্যু কে তারে কয়?
মরিয়া বাবর অমর হয়েছে, নাহি তার কোন ক্ষয়,
পিতৃস্নেহের কাছে হইয়াছে মরণের পরাজয়!
গোলাম মোস্তফা যশোর জেলার শৈলকুপা থানার মনোহরপুর গ্রামে ১৮৯৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯১৮ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বি.এ. পাস করেন। কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন সরকারি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। কাব্য, উপন্যাস, জীবনী, অনুবাদ ইত্যাদি সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় তাঁর স্বচ্ছন্দ পদচারণা ছিল । কাব্যচর্চার ক্ষেত্রেই ইসলামি ঐতিহ্য থেকে তিনি প্রেরণা লাভ করেছিলেন। তাঁর প্রকাশিত কাব্য: রক্তরাগ, খোশরোজ, কাব্যকাহিনী, সাহারা, হাস্নাহেনা, বুলবুলিস্তান, বনি আদম, উপন্যাস: ভাঙ্গাবুক, রূপের নেশা, এক মন এক প্রাণ; জীবনী : বিশ্বনবী, মরুদুলাল; অনুবাদ : কালামে ইকবাল, আল কুরআন, শিকওয়া ও জওয়াবে শিকওয়া ইত্যাদি। তিনি ১৯৬৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
বিনিময়- বদল । নিদ- ঘুম। ভিষকবৃন্দ- চিকিৎসকগণ । বাদশাজাদা- সম্রাটের পুত্র, এখানে হুমায়ুন। শেলসম- তীক্ষ্ণ অস্ত্রের মতো। শঙ্কা- ভয়। অস্তরবি-অস্তগামী সূর্য। দৃপ্ত- উদ্ধত (এখানে উদ্দীপিত অর্থে ব্যবহৃত)। সবচেয়ে যে শ্রেষ্ঠধন – প্রত্যেক মানুষের কাছে নিজের জীবনই শ্রেষ্ঠ ধন হিসেবে বিবেচ্য। ধেয়ানে- ধ্যানে।
সুপ্তিমগ্ন- ঘুমে অচেতন। ফুকারি- চিৎকার করে । কবুল- স্বীকার, গৃহীত।
তিমির রাতের তোরণে ঊষার পূর্বাভাস - ভোরের আগমন আঁধার রাতের অবসান ঘোষণা করে।
এখানে হুমায়ুনের মুমূর্ষু অবস্থা তিমির রাত এবং রোগমুক্তির লক্ষণকে ঊষার পূর্বাভাস বলা হয়েছে ।
‘জীবন বিনিময়’ কবিতাটি গোলাম মোস্তফার বুলবুলিস্তান কাব্য থেকে সংকলিত হয়েছে। কবিতাটিতে পিতৃস্নেহের একটি মহৎ দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত হয়েছে। পিতার স্নেহ-বাৎসল্যের কাছে মৃত্যুর পরাজয় এই কবিতার প্রতিপাদ্য বিষয়। মোগল সম্রাট বাবরের পুত্র হুমায়ুন কঠিন রোগে আক্রান্ত । বিজ্ঞ চিকিৎসকেরা অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে তাঁর জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছেন। এক দরবেশ এসে জানালেন যে, সম্রাট যদি তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ ধন দান করেন তবেই তাঁর পুত্র জীবন লাভ করতে পারেন। সম্রাট বাবর উপলব্ধি করলেন, নিজের প্রাণের চেয়ে আর বেশি প্রিয় কিছু নেই। তিনি বিধাতার কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ সে ধনের বিনিময়ে পুত্রের জীবন ভিক্ষা চাইলেন। আল্লাহ তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন। এভাবে পিতৃস্নেহের কাছে মরণের পরাজয় ঘটল । অর্থাৎ সন্তানের প্রতি পিতার অপরিসীম ভালোবাসা ও অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছে কবিতাটিতে।
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে ।
আজকে আমার রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে
বান ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার-ভাঙা কল্লোলে !
আসল হাসি, আসল কাঁদন,
মুক্তি এলো, আসল বাঁধন,
মুখ ফুটে আজ বুক ফাটে মোর তিক্ত দুখের সুখ আসে
ঐ রিক্ত বুকের দুখ আসে-
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে ।
আসল উদাস, শ্বসল হুতাশ,
সৃষ্টি-ছাড়া বুক-ফাটা শ্বাস,
ফুললো সাগর দুললো আকাশ ছুটলো বাতাস,
গগন ফেটে চক্র ছোটে, পিনাক-পাণির শূল আসে !
ঐ ধূমকেতু আর উল্কাতে
চায় সৃষ্টিটাকে উল্টাতে,
আজ তাই দেখি আর বক্ষে আমার লক্ষ বাগের ফুল হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে !
আজ হাসল আগুন, শ্বসল ফাগুন,
মদন মারে খুন-মাখা তূণ,
পলাশ অশোক শিমুল ঘায়েল
ফাগ লাগে ঐ দিক-বাসে
গো দিগ্বালিকার পীতবাসে;
আজ রঙন এলো রক্তপ্রাণের অঙ্গনে মোর চারপাশে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে !
আজ আসল ঊষা, সন্ধ্যা, দুপুর,
আসল নিকট, আসল সুদূর,
আসল বাধা-বন্ধ-হারা ছন্দ-মাতন
পাগলা-গাজন-উচ্ছ্বাসে !
ঐ আসল আশিন শিউলি শিথিল
হাসল শিশির দুবঘাসে।
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে !
আজ জাগল সাগর, হাসল মরু,
কাঁপল ভূধর, কানন-তরু,
বিশ্ব-ডুবান আসল তুফান, উছলে উজান
ভৈরবীদের গান ভাসে,
মোর ডাইনে শিশু সদ্যোজাত জরায়-মরা বামপাশে !
মন ছুটছে গো আজ বল্গা-হারা অশ্ব যেন পাগলা সে !
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে !
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে ॥
কাজী নজরুল ইসলাম ১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ সনে (২৪শে মে ১৮৯৯ সালে) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেবেলায় তিনি লেটো গানের দলে যোগ দেন। পরে বর্ধমানে ও ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার দরিরামপুর হাই স্কুলে লেখাপড়া করেন। ১৯১৭ সালে তিনি সেনাবাহিনীর বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে করাচি যান। সেখানেই তাঁর সাহিত্য-জীবনের সূচনা ঘটে। তাঁর লেখায় তিনি সামাজিক অবিচার ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। এজন্য তাঁকে 'বিদ্রোহী কবি' বলা হয়। বাংলা সাহিত্য জগতে তাঁর আবির্ভাব এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি সাহিত্যের সকল শাখায় তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি গজল, খেয়াল ও রাগপ্রধান গান রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। আরবি-ফারসি শব্দের সার্থক ব্যবহার তাঁর কবিতাকে বিশিষ্টতা দান করেছে। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে কবি দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর অসুস্থ কবিকে ঢাকায় আনা হয় এবং পরে তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। তাঁকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করা হয় । তাঁর অসাধারণ সাহিত্য-কীর্তির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধি প্ৰদান করে। তাঁর রচিত কাব্যগুলোর মধ্যে অগ্নি-বীণা, বিষের বাঁশি, ছায়ানট, প্রলয়শিখা, চক্রবাক, সিন্ধুহিন্দোল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ব্যথার দান, রিক্তের বেদন, শিউলিমালা, মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা ইত্যাদি তাঁর রচিত গল্প ও উপন্যাস । যুগবাণী, দুর্দিনের যাত্রী ও রাজবন্দীর জবানবন্দী তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ । ২৯শে আগস্ট ১৯৭৬ সালে কবি ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ-সংলগ্ন প্রাঙ্গণে তাকে পরিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়
সমাহিত করা হয় ।
উল্লাস - পরম (বা চূড়ান্ত) আনন্দ, হৃষ্টতা। সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে – সৃষ্টি করতে পারার পরম আনন্দ। পল্বল – বিল, ক্ষুদ্র জলাশয়। রুদ্ধ প্রাণের পল্বলে- প্রাণের বদ্ধ জলাশয়ে বা প্ৰাণ রূপ জলাশয়ে। কল্লোল -জলস্রোতের কলকল শব্দ, মহা তরঙ্গ বা ঢেউ। রুদ্ধ প্রাণের কল্লোলে - প্রাণ রূপ জলাশয়ে দুয়ার ভাঙা ঢেউ বা তরঙ্গ জোয়ার এনেছে। হুতাশ – অগ্নি, হুতাসন। শ্বসল নিঃশ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ করল। শ্বসল হুতাশ – অগ্নি নিঃশ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণ ও ত্যাগ করল—অর্থাৎ আগুন অতি তেজের সঙ্গে জ্বলে উঠল। চক্র- চাকা। এখানে হিন্দু পুরাণমতে দেবতা বিষ্ণুর হাতে - অন্যায় ধ্বংসকারী চাকাকে বোঝানো হয়েছে। পিনাক – হিন্দু পুরাণমতে দেবতা শিবের ধনু। পিনাকপাণি – পিনাক পাণিতে (হাতে) যার, শিব শূল – এখানে হিন্দু পুরাণমতে দেবতা শিবের হাতের ত্রিশূলকে বোঝানো হয়েছে। ফাগুন – ফালগুন বা বসন্তকাল। মদন - হিন্দু পুরাণমতে প্রেমের দেবতা। মদন মারে খুন মাখা তূণ প্রেমের দেবতা মানুষের হৃদয়ে তীর বিদ্ধ করেন বলে তা হৃদয়ের রক্ত মাখা বলে মনে করা হচ্ছে। ঘায়েল – আহত, আঘাতপ্রাপ্ত। এখানে বসন্তকালের রঙে রঞ্জিত বোঝানো হয়েছে। ফাগ – আবির, নানা রঙের গুঁড়ো। পীত – হলুদ রং, হলদে। দিগবালিকার পীতবাসে – দিগন্ত রূপ বালিকার হলুদ রঙের বস্ত্রে বা বসনে। গাজন – (পুরাণমতে) চৈত্র মাসের শেষে (অর্থাৎ বসন্তকালে) দেবতা শিবকে নিয়ে গান। আশিন- আশ্বিন মাস। দুব- দূর্বা, এক রকমের ঘাস। উছলে- উচ্ছলিত। উজান – স্রোতের বিপরীত দিক। ভৈরবী – শিব অনুসারী সন্ন্যাসিনী, ভয়ংকরী। বিশ্বভুবাল .... গান ভাসে- স্রোতের বিপরীত দিক থেকে ঠেলে বিশ্ব ডোবানো ঝড় এসেছে, তার সঙ্গে তাণ্ডব নৃত্যকারী শিবের অনুসারী সন্ন্যাসিনীদের গান মিশেছে। -
কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কয়েকটি কবিতার অন্যতম একটি হলো 'আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে'। কবিতাটি তাঁর দোলনচাঁপা কাব্য থেকে সংক্ষেপিত আকারে চয়ন করা হয়েছে। এই কবিতায় কবির সৃষ্টি-সুখের আনন্দ অসাধারণ আবেগ ও উচ্ছ্বাসের মধ্যে ব্যক্ত হয়েছে। কবির ভাবনায়, বিশ্বাসে ও জাগতিক নিয়মে এতদিন যা ছিল রুদ্ধ তা যেন আজ শতধারায় উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে। সর্বত্রই এখন তিনি অনুভব করেন সৃষ্টির কোলাহল, গতির উন্মাদনা, প্রাণের উচ্ছ্বাস আর মুক্তির আনন্দ। এই অফুরন্ত ভাবাবেগ প্রকাশ করতে গিয়ে কবি যে কাব্যভাষা প্রয়োগ করেছেন বাংলা কবিতার ইতিহাসে তা একেবারেই নতুন। এই কবিতার মধ্যে নজরুলের কাব্য প্রতিভার সকল মাত্রার আনন্দিত প্রকাশ লক্ষ করা যায়। একইভাবে মানবসত্তার চিরন্তন উল্লাস ও জীবনমুখীতাও প্রকাশ পেয়েছে।
গাহি সাম্যের গান -
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান
নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি,
সব দেশে সব কালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি ।
‘পূজারী, দুয়ার খোলো,
ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হলো!”
স্বপন দেখিয়া আকুল পূজারী খুলিল ভজনালয়,
দেবতার বরে আজ রাজা-টাজা হয়ে যাবে নিশ্চয় !
জীর্ণ-বস্ত্র শীর্ণ-গাত্র, ক্ষুধায় কণ্ঠ ক্ষীণ—
ডাকিল পান্থ, ‘দ্বার খোলো বাবা, খাইনি তো সাত দিন!”
সহসা বন্ধ হলো মন্দির, ভুখারি ফিরিয়া চলে,
তিমিররাত্রি, পথ জুড়ে তার ক্ষুধার মানিক জ্বলে !
ভুখারি ফুকারি' কয়,
‘ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয়!
মসজিদে কাল শিরনি আছিল, – অঢেল গোস্ত রুটি
বাঁচিয়া গিয়াছে, মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটি কুটি,
এমন সময় এলো মুসাফির গায়ে আজারির চিন
বলে, “বাবা, আমি ভুখা ফাকা আছি আজ নিয়ে সাত দিন!'
তেরিয়া হইয়া হাঁকিল মোল্লা-'ভ্যালা হলো দেখি লেঠা,
ভুখা আছ মর গো-ভাগাড়ে গিয়ে! নমাজ পড়িস বেটা?”
ভুখারি কহিল, 'না বাবা!' মোল্লা হাঁকিল-'তা হলে শালা
সোজা পথ দেখ!' গোস্ত-রুটি নিয়া মসজিদে দিল তালা ।
ভুখারি ফিরিয়া চলে,
চলিতে চলিতে বলে-
‘আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু,
আমার ক্ষুধার অন্ন তা বলে বন্ধ করনি প্রভু ।
তব মসজিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবি।
মোল্লা পুরুত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবি !”
কোথা চেঙ্গিস, গজনি মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়?
ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া দ্বার !
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা!
হায় রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয় !
২০২১
কাজী নজরুল ইসলাম ১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ সনে (২৪শে মে ১৮৯৯ সালে) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেবেলায় তিনি লেটো গানের দলে যোগ দেন। পরে বর্ধমানে ও ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার দরিরামপুর হাই স্কুলে লেখাপড়া করেন। ১৯১৭ সালে তিনি সেনাবাহিনীর বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে করাচি যান। সেখানেই তাঁর সাহিত্য-জীবনের সূচনা ঘটে। তাঁর লেখায় তিনি সামাজিক অবিচার ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। এজন্য তাঁকে 'বিদ্রোহী কবি' বলা হয়। বাংলা সাহিত্য জগতে তাঁর আবির্ভাব এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি সাহিত্যের সকল শাখায় তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি গজল, খেয়াল ও রাগপ্রধান গান রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। আরবি-ফারসি শব্দের সার্থক ব্যবহার তাঁর কবিতাকে বিশিষ্টতা দান করেছে। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে কবি দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর অসুস্থ কবিকে ঢাকায় আনা হয় এবং পরে তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। তাঁকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করা হয় । তাঁর অসাধারণ সাহিত্য-কীর্তির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধি প্ৰদান করে। তাঁর রচিত কাব্যগুলোর মধ্যে অগ্নি-বীণা, বিষের বাঁশি, ছায়ানট, প্রলয়শিখা, চক্রবাক, সিন্ধুহিন্দোল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ব্যথার দান, রিক্তের বেদন, শিউলিমালা, মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা ইত্যাদি তাঁর রচিত গল্প ও উপন্যাস । যুগবাণী, দুর্দিনের যাত্রী ও রাজবন্দীর জবানবন্দী তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ । ২৯শে আগস্ট ১৯৭৬ সালে কবি ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ-সংলগ্ন প্রাঙ্গণে তাকে পরিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়
সমাহিত করা হয় ।
সাম্য- সমতা। মহীয়ান— অতি মহান, ঠাকুর – দেবতা। ক্ষুধার ঠাকুর - ক্ষুধার্ত মানুষকে দেবতাজ্ঞান করা হয়েছে। যেমন ‘অতিথি নারায়ণ’। বর – আশীর্বাদ। কারো কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত বস্তু বা বিষয়। পান্থ – পথিক। ভুখারি – ক্ষুধার্ত ব্যক্তি। ক্ষুধার মানিক জ্বলে - ক্ষুধার্ত ব্যক্তির - জঠরজ্বালা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ফুকারি – চিৎকার করে। আজারি - রুগ্ণ, ব্যথিত। তেরিয়া - উদ্ধতভাবে, উগ্রভাবে, ক্রুদ্ধভাবে। গো-ভাগাড় – মৃত গরু ফেলার নির্দিষ্ট স্থান। পুরুত – পুরোহিত, পূজার্চনা পরিচালনার মুখ্য ব্যক্তি। চেঙ্গিস - চেঙ্গিস খান। গজনি মামুদ – গজনির সুলতান মাহমুদ তিনি সতের বার ভারতবর্ষ আক্রমণ করে ধ্বংসলীলা চালান। এখানে তাঁকে উপাসনালয়ের ভণ্ড দুয়ারীদের ধ্বংস করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। কালাপাহাড় - প্রকৃত নাম রাজচন্দ্র বা রাজকৃষ্ণ বা রাজনারায়ণ, কারো কারো মতে তিনি ব্রাহ্মণ ছিলেন। পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি অনেক দেবালয় ধ্বংস করেছেন। যারা পবিত্র উপাসনালয়ের দরোজা বন্ধ করে, তাদের ধ্বংসের জন্য কবিতায় কালাপাহাড়কে আহ্বান জানানো হয়েছে।
কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যবাদী কাব্য থেকে মানুষ কবিতাটি সম্পাদনা করে সংকলিত হয়েছে। পৃথিবীতে নানা বর্ণ, ধর্ম, গোত্র আছে। বিভিন্ন ধর্মের জন্য পৃথক পৃথক ধর্মগ্রন্থও আছে। মানুষ ধর্মগ্রন্থগুলোকে খুবই শ্রদ্ধা করে, ধর্মের জন্য জীবনবাজিও রাখে। কিন্তু নিরন্ন অসহায়কে অনেক সময় তারা সামর্থ্য থাকার পরও অন্ন দান করে না । মন্দিরের পুরোহিত বা মসজিদের মোল্লা সাহেবরাও অনেক সময় এ রকম হৃদয়হীন কাজ করেন। মানুষের চেয়ে বড়ো কিছু যে হতে পারে না, ধর্মও সে কথাই বলে । অথচ ধর্মকে ব্যবহার করে অনেকে স্বার্থ হাসিল করে এবং মনুষ্যত্বের চরম অবমাননা করে; যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কবিতায় সে ভাবটিই মূর্ত হয়ে উঠেছে।
তিমির রাত্রি-‘এশা’র আযান শুনি দূর মসজিদে ।
প্রিয়-হারা কার কান্নার মত এ-বুকে আসিয়া বিঁধে
আমির-উল-মুমেনিন,
তোমার স্মৃতি যে আযানের ধ্বনি জানে না মুয়াজ্জিন ।
তকবির শুনি, শয্যা ছাড়িয়া চকিতে উঠিয়া বসি,
বাতায়নে চাই-উঠিয়াছে কি-রে গগনে মরুর শশী ?
ও-আযান, ও কি পাপিয়ার ডাক, ও কি চকোরীর গান?
মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে ও কি ও তোমারি সে আহ্বান ?
আবার লুটায়ে পড়ি।
“সেদিন গিয়াছে”-শিয়রের কাছে কহিছে কালের ঘড়ি।
উমর! ফারুক! আখেরী নবীর ওগো দক্ষিণ-বাহু!
আহ্বান নয় - রূপ ধরে এস - গ্রাসে অন্ধতা - রাহু!
ইসলাম-রবি, জ্যোতি তার আজ দিনে দিনে বিমলিন!
সত্যের আলো নিভিয়া-জ্বলিছে জোনাকির আলো ক্ষীণ!
শুধু আঙ্গুলি হেলনে শাসন করিতে এ জগতের
দিয়াছিলে ফেলি মুহম্মদের চরণে যে-শমশের
ফিরদৌস ছাড়ি নেমে এস তুমি সেই শমশের
ধরি আর একবার লোহিত-সাগরে লালে-লাল হয়ে মরি!
ইসলাম-সে তো পরশ-মানিক তাকে কে পেয়েছে খুঁজি ?
পরশে তাহার সোনা হল যারা তাদেরেই মোরা বুঝি ।
আজ বুঝি—কেন বলিয়াছিলেন শেষ পয়গম্বর-
মোর পরে যদি নবী হত কেউ, হত সে এক উমর।'
************************************************
অর্ধ পৃথিবী করেছ শাসন ধূলার তখতে বসি
খেজুর পাতার প্রাসাদ তোমার বারে বারে গেছে খসি
সাইমুম-ঝড়ে। পড়েছে কুটির, তুমি পড়নি ক‘নুয়ে,
ঊর্ধ্বের যারা-পড়েছে তাহারা, তুমি ছিলে খাড়া ভুয়ে ।
শত প্রলোভন বিলাস বাসনা ঐশ্বর্যের মদ
করেছে সালাম দূর হতে সব ছুঁইতে পারেনি পদ ।
সবারে ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়া তুমি ছিলে সব নিচে,
বুকে করে সবে বেড়া করি পার, আপনি রহিলে পিছে ।
হেরি পশ্চাতে চাহি-
তুমি চলিয়াছ রোদ্রদগ্ধ দূর মরুপথ বাহি
জেরুজালেমের কিল্লা যথায় আছে অবরোধ করি
বীর মুসলিম সেনাদল তব বহু দিন মাস ধরি।
দুর্গের দ্বার খুলিবে তাহারা বলেছে শত্রু শেষে-
উমর যদি গো সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করে এসে!
হায় রে, আধেক ধরার মালিক আমির-উল-মুমেনিন
শুনে সে খবর একাকী উষ্ট্রে চলেছে বিরামহীন
সাহারা পারায়ে! ঝুলিতে দু খানা শুকনো ‘খবুজ' রুটি
একটি মশকে একটুকু পানি খোমা দু তিন মুঠি ।
প্রহরীবিহীন সম্রাট চলে একা পথে উটে চড়ি
চলেছে একটি মাত্র ভৃত্য উষ্ট্রের রশি ধরি!
মরুর সূর্য ঊর্ধ্ব আকাশে আগুন বৃষ্টি করে,
সে আগুন-তাতে খই সম ফোটে বালুকা মরুর পরে ।
কিছুদুর যেতে উট হতে নামি কহিলে ভৃত্যে, “ভাই
পেরেশান বড় হয়েছ চলিয়া! এইবার আমি যাই
উষ্ট্রের রশি ধরিয়া অগ্রে, তুমি উঠে বস উটে,
তপ্ত বালুতে চলি যে চরণে রক্ত উঠেছে ফুটে।”
..ভৃত্য দস্ত চুমি
কাঁদিয়া কহিল, ‘উমর! কেমনে এ আদেশ কর তুমি?
উষ্ট্রের পিঠে আরাম করিয়া গোলাম রহিবে বসি
আর হেঁটে যাবে খলিফা উমর ধরি সে উটের রশি ?
খলিফা হাসিয়া বলে,
“তুমি জিতে গিয়ে বড় হতে চাও, ভাই রে, এমনি ছলে ।
রোজ-কিয়ামতে আল্লাহ যে দিন কহিবে, ‘উমর! ওরে
করে নি খলিফা, মুসলিম-জাঁহা তোর সুখ তরে তোরে।'
উমর ফারুক
কী দিব জওয়াব কী করিয়া মুখ দেখাব রসুলে ভাই ।
আমি তোমাদের প্রতিনিধি শুধু। মোর অধিকার নাই ।
আরাম সুখের, - মানুষ হইয়া নিতে মানুষের সেবা ।
ইসলাম বলে, সকলে সমান, কে বড় ক্ষুদ্র কেবা ।
ভৃত্য চড়িল উটের পৃষ্ঠে উমর ধরিল রশি,
মানুষেরে স্বর্গে তুলিয়া ধরিয়া ধুলায় নামিল শশী ।
জানি না, সেদিন আকাশে পুষ্প বৃষ্টি হইল কিনা,
কী গান গাহিল মানুষে সেদিন বন্দি' বিশ্ববীণা ।
জানি না, সেদিন ফেরেশতা তব করেছে কি না স্তব-
অনাগত কাল গেয়েছিল শুধু, ‘জয় জয় হে মানব ৷'
************************************************
তুমি নিৰ্ভীক, এক খোদা ছাড়া করনি ক' কারে ভয়,
সত্যব্রত তোমায় তাইতে সবে উদ্ধত কয় ।
মানুষ হইয়া মানুষের পূজা মানুষেরি অপমান,
তাই মহাবীর খালেদেরে তুমি পাঠাইলে ফরমান,
সিপাহ-সালারে, ইঙ্গিতে তব করিলে মামুলি সেনা,
বিশ্ব-বিজয়ী বীরেরে শাসিতে এতটুকু টলিলে না ।
************************************************
মানব-প্রেমিক! আজিকে তোমারে স্মরি,
মনে পড়ে তব মহত্ত্ব-কথা-সেদিন সে বিভাবরী
নগর-ভ্রমণে বাহিরিয়া তুমি দেখিতে পাইলে দূরে
মায়েরে ঘিরিয়া ক্ষুধাতুর দুটি শিশু সকরুণ সুরে
কাঁদিতেছে আর দুঃখিনী মাতা ছেলেরে ভুলাতে হায়,
উনানে শূন্য হাঁড়ি চড়াইয়া কাঁদিয়া অকূলে চায় ৷
শুনিয়া সকল-কাঁদিতে কাঁদিতে ছুটে গেলে মদিনাতে
বায়তুল-মাল হইতে লইয়া ঘৃত আটা নিজ হাতে,
বলিলে, ‘এ সব চাপাইয়া দাও আমার পিঠের' পরে,
আমি লয়ে যাব বহিয়া এ-সব দুখিনী মায়ের ঘরে।'
কত লোক আসি আপনি চাহিল বহিতে তোমার বোঝা,
বলিলে, বন্ধু, আমার এ ভার আমিই বহিব সোজা !
রোজ-কিয়ামতে কে বহিবে বল আমার পাপের ভার?
মম অপরাধে ক্ষুধায় শিশুরা কাঁদিয়াছে, আজি তার
প্রায়শ্চিত্ত করিব আপনি'- চলিলে নিশীথ রাতে
পৃষ্ঠে বহিয়া খাদ্যের বোঝা দুখিনীর আঙিনাতে!
এত যে কোমল প্ৰাণ,
করুণার বশে তবু গো ন্যায়ের করনি কো অপমান!
মদ্যপানের অপরাধে প্রিয় পুত্রেরে নিজ করে
মেরেছ দোর্রা, মরেছে পুত্র তোমার চোখের পরে
ক্ষমা চাহিয়াছে পুত্র, বলেছ পাষাণে বক্ষ বাঁধি-
‘অপরাধ করে তোরি মত স্বরে কাঁদিয়াছে অপরাধী।'
আবু শাহমার গোরে
কাঁদিতে যাইয়া ফিরিয়া আসি গো তোমারে সালাম করে ।
খাস দরবার ভরিয়া গিয়াছে হাজার দেশের লোকে,
‘কোথায় খলিফা’ কেবলি প্রশ্ন ভাসে উৎসুক চোখে,
একটি মাত্র পিরান কাচিয়া শুকায়নি তাহা বলে,
রোদ্রে ধরিয়া বসিয়া আছে গো খলিফা আঙিনা-তলে ।
হে খলিফাতুল-মুসলেমিন! হে চীরধারী সম্রাট!
অপমান তব করিব না আজ করিয়া নান্দী পাঠ,
মানুষেরে তুমি বলেছ বন্ধু, বলিয়াছ ভাই, তাই
তোমারে এমন চোখের পানিতে স্মরি গো সর্বদাই ।
(সংক্ষেপিত)
কাজী নজরুল ইসলাম ১১ই জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ সনে (২৪শে মে ১৮৯৯ সালে) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেবেলায় তিনি লেটো গানের দলে যোগ দেন। পরে বর্ধমানে ও ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার দরিরামপুর হাই স্কুলে লেখাপড়া করেন। ১৯১৭ সালে তিনি সেনাবাহিনীর বাঙালি পল্টনে যোগ দিয়ে করাচি যান। সেখানেই তাঁর সাহিত্য-জীবনের সূচনা ঘটে। তাঁর লেখায় তিনি সামাজিক অবিচার ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। এজন্য তাঁকে 'বিদ্রোহী কবি' বলা হয়। বাংলা সাহিত্য জগতে তাঁর আবির্ভাব এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে। কবিতা, উপন্যাস, নাটক, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি সাহিত্যের সকল শাখায় তিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি গজল, খেয়াল ও রাগপ্রধান গান রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। আরবি-ফারসি শব্দের সার্থক ব্যবহার তাঁর কবিতাকে বিশিষ্টতা দান করেছে। মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে কবি দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর অসুস্থ কবিকে ঢাকায় আনা হয় এবং পরে তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। তাঁকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায় ভূষিত করা হয় । তাঁর অসাধারণ সাহিত্য-কীর্তির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধি প্ৰদান করে। তাঁর রচিত কাব্যগুলোর মধ্যে অগ্নি-বীণা, বিষের বাঁশি, ছায়ানট, প্রলয়শিখা, চক্রবাক, সিন্ধুহিন্দোল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ব্যথার দান, রিক্তের বেদন, শিউলিমালা, মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা ইত্যাদি তাঁর রচিত গল্প ও উপন্যাস । যুগবাণী, দুর্দিনের যাত্রী ও রাজবন্দীর জবানবন্দী তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ । ২৯শে আগস্ট ১৯৭৬ সালে কবি ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ-সংলগ্ন প্রাঙ্গণে তাকে পরিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়
সমাহিত করা হয় ।
তাপ- উত্তাপ। হস্ত- হাত। পেরেসান- বিপর্যস্ত, ক্লান্ত। আমির উল-মুমেনিন - বিশ্বাসীদের নেতা, এখানে বিশেষভাবে বোঝানো হয়েছে মুসলামানদের ধর্মীয় প্রধান ও রাষ্ট্রীয় নেতা হযরত উমর (রা) কে । মুয়াজ্জিন- যিনি আযান দেন। তকবির-‘আল্লাহ' ধ্বনি বা রব। আখেরি- শেষ। পরশমণি - স্পর্শমণি, যার ছোঁয়ায় লোহাও সোনা হয়। তখত- সিংহাসন। সাইমুম- শুকনো উত্তপ্ত শ্বাসরোধকারী প্রবল হাওয়া- বিশেষত মরুভূমির হাওয়া। মশক- পানি বইবার চামড়ার থলে। দোর্রা- চাবুক। চীর- ছিন্ন বস্ত্র । পিরান- জামা। নান্দী- স্তুতি। কাব্যপাঠ বা নাটকের শুরুতে ছোট করে মঙ্গলসূচক প্রশস্তি পাঠ। শমসের- তরবারি। দস্ত-হাত। পেরেশান- বিপর্যস্ত, ক্লান্ত ।
উমর ফারুক- ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা। তাঁর খেলাফতের সময়কাল দশ বছর (৬৩৪-৬৪৪ খ্রিষ্টাব্দ)। তাঁর শাসনামলে ইসলামি রাষ্ট্রের সীমা আরব সাম্রাজ্য থেকে মিশর ও তুর্কিস্থানের সীমা পর্যন্ত প্রসারিত হয়। একজন ন্যায়নিষ্ঠ, নির্ভীক ও গণতন্ত্রমনা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাঁর খ্যাতি চির অম্লান। ‘ফারুক’ হযরত উমরের উপাধি। যিনি সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করতে পারেন তাঁকেই ‘ফারুক’ বলা হয়। হযরত উমর (রা.) ছিলেন সত্যের একজন দৃঢ়চিত্ত উপাসক ৷
‘তোমার স্মৃতি যে আযানের ধ্বনি জানে না মুয়াজ্জিন’- হযরত উমরের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পূর্বে নামাজের জন্য প্রকাশ্য আজান দেয়ার রীতি ছিল না। কোরেশদের ভয়ে মুসলমানরা উচ্চরবে আজান দিতে সাহস পেত না। উমর ছিলেন কোরেশ বংশোদ্ভূত শ্রেষ্ঠবীর । তিনি যখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেন, তখন প্রকাশ্যে আজান দিতে আর কোনো বাধা রইল না। তাই আজানের সঙ্গে যে উমরের স্মৃতি বিজড়িত সে কথা অনেক মুয়াজ্জিন জানে না ।
জেরুজালেম- ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের একটি প্রাচীন শহর জেরুজালেম।
আবু শাহামা- হযরত উমরের পুত্র। মদপানের অপরাধে খলিফা তাকে ৮০টি বেত্রাঘাতের নির্দেশ দেন এবং নিজেই বেত্রাঘাত করেন। বেত্রাঘাতের ফলে আবু শাহমার মৃত্যু হয় ।
উমর ফারুক কবিতাটি কাজী নজরুল ইসলামের জিঞ্জীর কাব্য থেকে সংকলিত হয়েছে। কবিতাটিতে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত উমর (রা)-এর জীবনাদর্শ, চরিত্র-মাহাত্ম্য, মানবিকতা এবং সাম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। খলিফা উমর (রা) ছিলেন একজন মহৎ ব্যক্তিত্ব। তাঁর চরিত্রে একাধারে বীরত্ব, কোমলতা, নিষ্ঠা এবং সাম্যবাদী আদর্শের অনন্য সমন্বয় ঘটেছিল। বিশাল মুসলিম রাষ্ট্রের সর্বাধিনায়ক হয়েও তিনি অতি সহজ, সরল, অনাড়ম্বর জীবন যাপন করেছেন। নিজ ভৃত্যকেও তিনি তাঁর সঙ্গে সমান মর্যাদা দিতে কুণ্ঠিত হননি। ন্যায়ের আদর্শ সমুন্নত রাখতে তিনি আপন সন্তানকে কঠোরতম শাস্তি দিতেও দ্বিধাবোধ করেননি । তিনি ছিলেন আমির-উল-মুমেনিন। রাসুলুল্লাহ (স.) তাঁকে আদর্শবান ব্যক্তিত্ব বলে বিশ্বাস করেই বলেছিলেন, তাঁর পরে যদি কেউ নবি হতেন, তাহলে তিনি হতেন উমর । মহৎপ্রাণ ও আদর্শ মানব চরিত্র অর্জনের জন্য উমর ফারুককে কবি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে কবিতায় উপস্থাপন করেছেন।
সেই দিন এই মাঠ স্তব্ধ হবে নাকো জানি -
এই নদী নক্ষত্রের তলে
সেদিনো দেখিবে স্বপ্ন -
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে!
আমি চলে যাব বলে
চালতাফুল কি আর ভিজিবে না শিশিরের জলে
নরম গন্ধের ঢেউয়ে ?
লক্ষ্মীপেঁচা গান গাবে নাকি তার লক্ষ্মীটির তরে?
সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে!
চারিদিকে শান্ত বাতি – ভিজে গন্ধ – মৃদু কলরব;
খেয়ানৌকোগুলো এসে লেগেছে চরের খুব কাছে;
পৃথিবীর এইসব গল্প বেঁচে রবে চিরকাল;
এশিরিয়া ধুলো আজ – বেবিলন ছাই হয়ে আছে।
জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ সালে বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সত্যানন্দ দাশ, মাতা কুসুমকুমারী দাশ। কুসুমকুমারী দাশও ছিলেন একজন স্বভাবকবি। জীবনানন্দ দাশ বরিশাল ব্রজমোহন স্কুল, ব্রজমোহন কলেজ ও কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষালাভ করেন। ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ. ডিগ্রি লাভের পর তিনি অধ্যাপনা শুরু করেন এবং সুদীর্ঘকাল তিনি অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। জীবনানন্দ দাশ প্রধানত আধুনিক জীবনচেতনার কবি হিসেবে পরিচিত । বাংলার প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্যে কবি নিমগ্নচিত্ত। কবির দৃষ্টিতে বাংলাদেশ এক অনন্য রূপসী। এ দেশের গাছপালা, লতাগুল্ম, ফুল-পাখি তাঁর আজন্ম প্রিয়। তাঁর রচিত গ্রন্থ : ঝরা পালক, ধূসর পাণ্ডুলিপি, বনলতা সেন, মহাপৃথিবী, সাতটি তারার তিমির, কবিতার কথা, রূপসী বাংলা, বেলা অবেলা কালবেলা, মাল্যবান, সুতীর্থ ইত্যাদি। ১৯৫৪ সালের ১৪ই অক্টোবর জীবনানন্দ দাশ কলকাতায় এক ট্রাম-দুর্ঘটনায় আহত হন এবং ২২শে অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন ।
সেইদিন এই মাঠ ...কবে আর ঝরে – জীবনানন্দ দাশ প্রকৃতির কবি । প্রকৃতির রহস্যময় সৌন্দর্য তাঁর কবিতার মৌলিক প্রেরণা। তিনি জানেন বিচিত্র বিবর্তনের মধ্যেও প্রকৃতি তাঁর রূপ-রস-গন্ধ কখনই হারিয়ে ফেলবে না। তিনি যখন থাকবেন না তখনও প্রকৃতি তার অফুরন্ত ঐশ্বর্য নিয়ে মানুষের স্বপ্ন- সাধ ও কল্পনাকে তৃপ্ত করে যাবে। আলোচ্য অংশে কবি প্রকৃতির এই মাহাত্ম্যকে গভীর তৃপ্তি ও মমত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন।
আমি চলে যাব বলে... লক্ষ্মীটির তরে পৃথিবীতে কেউই চিরস্থায়ী নয়। প্রত্যেক মানুষকেই এক সময় চলে যেতে হয়। কিন্তু শিশিরের জলে চালতা ফুল ভিজে যে রহস্যময় সৌন্দর্য সৃষ্টি হয় যুগ-যুগান্তে তার কোনো শেষ নেই । আর সেই শিশিরের জলে ভেজা চালতা ফুলের গন্ধের ঢেউ প্রবাহিত হতে থাকবে অনন্তকালব্যাপী । কবির এই বোধের মধ্যে প্রকৃতির এক শাশ্বতরূপ মূর্ত হয়ে উঠেছে, যেখানে লক্ষ্মীপেঁচাটির মমত্বের অনুভাবনাও ধরা দিয়েছে অসাধারণ এক তাৎপর্যে।
এশিরিয়া ধুলো আজ ... - মানুষের গড়া পৃথিবীর অনেক সভ্যতা বিলীন হয়ে গেছে। এশিরিয় ও ব্যাবিলনীয় সভ্যতা এখন ধ্বংসস্তূপ ছাড়া কিছু নয় ।বাংলা সাহিত্য কিন্তু প্রকৃতি তার আপন রূপ-রস-গন্ধ নিয়ে চিরকাল প্রাণময় থাকে। প্রকৃতির মধ্যে বিচিত্র গন্ধে আস্বাদ মৃদুমন্দ কোলাহলের আনন্দ, তার অন্তর্গত অফুরন্ত সৌন্দর্য কখনই শেষ হয় না। কবিতাটিতে জীবনানন্দ দাশ প্রকৃতির এই চিরকালীন সৌন্দর্যকে বিস্ময়কর নিপুণতায় উপস্থাপন করেছেন।
‘সেইদিন এই মাঠ' কবিতাটি জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা কাব্য থেকে সংকলিত হয়েছে। সভ্যতা একদিকে যেমন ক্ষয়িষ্ণু অন্যদিকে চলে তার বিনির্মাণ। মরণশীল ব্যক্তিমানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, কিন্তু প্রকৃতিতে থাকে চিরকালের ব্যস্ততা। মাঠে থাকে চঞ্চলতা, চালতাফুলে পড়ে শীতের শিশির, লক্ষ্মীপেচকের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় মঙ্গলবার্তা, খেয়া নৌকা চলে নদীনালাতে অর্থাৎ কোথাও থাকে না সেই মৃত্যুর রেশ। ফলে মৃত্যুতেই সব শেষ নয়, পৃথিবীর বহমানতা মানুষের সাধারণ মৃত্যু রহিত করতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে মানুষের মৃত্যু আছে কিন্তু এ জগতে সৌন্দর্যের মৃত্যু নেই, মানুষের স্বপ্নেরও মরণ নেই । গভীর জীবনতৃষ্ণা নিয়ে এই সত্যই কবিতাটিতে অনুভূত হয়েছে।
রাত থম থম স্তব্ধ নিঝুম, ঘোর-ঘোর-আন্ধার,
নিশ্বাস ফেলি তাও শোনা যায় নাই কোথা সাড়া কার ।
রুণ ছেলের শিয়রে বসিয়া একেলা জাগিছে মাতা,
করুণ চাহনি ঘুম ঘুম যেন ঢুলিছে চোখের পাতা ।
শিয়রের কাছে নিবু নিবু দীপ ঘুরিয়া ঘুরিয়া জ্বলে,
তারি সাথে সাথে বিরহী মায়ের একেলা পরাণ দোলে ।
ভন ভন ভন জমাট বেঁধেছে বুনো মশকের গান
এঁদো ডোবা হতে বহিছে কঠোর পচান পাতার ঘ্রাণ ।
ছোট কুঁড়েঘর, বেড়ার ফাঁকেতে আসিছে শীতের বায়ু,
শিয়রে বসিয়া মনে মনে মাতা গণিছে ছেলের আয়ু ।
ছেলে কয়, ‘মারে, কত রাত আছে, কখন সকাল হবে,
ভালো যে লাগে না, এমনি করিয়া কেবা শুয়ে থাকে কবে ।’
মা কয়, ‘বাছারে ! চুপটি করিয়া ঘুমো ত একটি বার',
ছেলে রেগে কয়, ‘ঘুম যে আসে না কি করিব আমি তার ।'
পাণ্ডুর গালে চুমো খায় মাতা । সারা গায়ে দেয় হাত,
পারে যদি বুকে যত স্নেহ আছে ঢেলে দেয় তারি সাথ ।
নামাজের ঘরে মোমবাতি মানে, দরগায় মানে দান
, ছেলেরে তাহার ভালো করে দাও কাঁদে জননীর প্রাণ ।
ভালো করে দাও আল্লা-রসুল! ভালো করে দাও পীর,
কহিতে কহিতে মুখখানি ভাসে বহিয়া নয়ন নীর!
বাঁশ বনে বসি ডাকে কানা কুয়ো, রাতের আঁধার ঠেলি,
বাদুড় পাখার বাতাসেতে পড়ে সুপারির বন হেলি ।
চলে বুনো পথে জোনাকি মেয়েরা কুয়াশা কাফন ধরি,
দুঃ ছাই! কিবা শঙ্কায় মার পরাণ উঠিছে ভরি ।
যে কথা ভাবিতে পরাণ শিহরে তাই ভাসে হিয়া কোণে,
বালাই বালাই, ভালো হবে যাদু মনে মনে জাল বোনে ।
ছেলে কয়, ‘মাগো, পায়ে পড়ি বল ভালো যদি হই কাল,
করিমের সাথে খেলিবারে গেলে দিবে নাত তুমি গাল ।
আচ্ছা মা বলো, এমন হয় না রহিম চাচার ঝাড়া,
এখনি আমারে এত রোগ হতে করিতে পারেত খাড়া?'
মা কেবল বসি রুগ্ণ ছেলের মুখ পানে আঁখি মেলে,
ভাসা ভাসা তার যত কথা যেন সারা প্রাণ দিয়ে গেলে ।
‘শোন মা, আমার লাটাই কিন্তু রাখিও যতন করে,
রাখিও ঢ্যাপের মোয়া বেঁধে তুমি সাতনরি সিকা ভরে ।
খেজুরে গুড়ের নয়া পাটালিতে হুডুমের কোলা ভরে ।
ফুলঝুরি সিকা সাজাইয়া রেখো আমার সমুখ পরে।'
ছেলে চুপ করে, মাও ধীরে ধীরে মাথায় বুলায় হাত,
বাহিরেতে নাচে জোনাকি আলোয় থম থম কাল রাত ।
রুণ ছেলের শিয়রে বসিয়া কত কথা পড়ে মনে,
কোন দিন সে যে মায়েরে না বলে গিয়াছিল দূর বনে ।
সাঁঝ হয়ে গেল তবু আসে নাকো, আই ঢাই মার প্রাণ,
হঠাৎ শুনিল আসিতেছে ছেলে হর্ষে করিয়া গান ।
এক কোঁচ ভরা বেথুল তাহার ঝামুর ঝুমুর বাজে,
ওরে মুখপোড়া কোথা গিয়াছিলি এমনি এ কালি সাঁঝে ।
কত কথা আজ মনে পড়ে তার, গরীবের ঘর তার,
ছোটখাট কত বায়না ছেলের পারে নাই মিটাবার ।
আড়ঙের দিনে পুতুল কিনিতে পয়সা জোটেনি তাই,
বলেছে আমরা, মুসলমানের আড়ং দেখিতে নাই ।
করিম সে গেল? আজিজ চলিল? এমনি প্ৰশ্ন মালা,
উত্তর দিতে দুখিনী মায়ের দ্বিগুণ বাড়িত জ্বালা ।
আজও রোগে তার পথ্য জোটে নি, ওষুধ হয়নি আনা,
ঝড়ে কাঁপে যেন নীড়ের পাখিটি জড়ায়ে মায়ের ডানা ।
ঘরের চালেতে হুতুম ডাকিছে, অকল্যাণ এ সুর,
মরণের দূত এলো বুঝি হায়, হাঁকে মায়, দূর-দূর ।
পচা ডোবা হতে বিরহিনী ডাক ডাকিতেছে ঝুরি' ঝুরি',
কৃষাণ ছেলেরা কালকে তাহার বাচ্চা করেছে চুরি ।
ফেরে ভন্ ভন্ মশা দলে দলে, বুড়ো পাতা ঝরে বনে,
ফোঁটায় ফোঁটায় পাতা-চোঁয়া জল ঝরিছে তাহার সনে ।
রুণ ছেলের শিয়রে বসিয়া একেলা জাগিছে মাতা,
সম্মুখে তার ঘোর কুজ্বটি মহাকাল রাত পাতা ।
পার্শ্বে জ্বলিয়া মাটির প্রদীপ বাতাসে জমায় খেল;
আঁধারের সাথে যুঝিয়া তাহার ফুরায়ে এসেছে তেল ।
জসীমউদ্দীন ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে ফরিদপুর জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । কবি তাঁর কবিতায় বাংলাদেশের পল্লিপ্রকৃতি ও মানুষের সহজ স্বাভাবিক রূপটি তুলে ধরেছেন । পল্লির মাটি ও মানুষের জীবনচিত্র তাঁর কবিতায় নতুন মাত্রা পেয়েছে । পল্লির মানুষের আশা-স্বপ্ন- আনন্দ-বেদনা ও বিরহ- মিলনের এমন আবেগ-মধুর চিত্র আর কোনো কবির কাব্যে খুঁজে পাওয়া ভার । এ কারণে তিনি ‘পল্লিকবি’ নামে খ্যাত । কর্মজীবনের শুরুতে তিনি কিছুকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন । পরে সরকারি তথ্য ও প্রচার বিভাগে উচ্চপদে যোগদান করেন । ছাত্রজীবনেই তাঁর কবিপ্রতিভার বিকাশ ঘটে । বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই তাঁর রচিত 'কবর' কবিতাটি প্রবেশিকা বাংলা সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয় । জসীমউদ্দীনের উল্লেখযোগ্য কাব্যের মধ্যে রয়েছে নক্সী- কাঁথার মাঠ, সোজনবাদিয়ার ঘাট, রাখালী, বালুচর, হাসু, এক পয়সার বাঁশি, মাটির কান্না ইত্যাদি । তাঁর নক্সী-কাঁথার মাঠ কাব্য বিভিন্ন বিদেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে । চলে মুসাফির তাঁর ভ্রমণকাহিনী । বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডি.লিট ডিগ্রি প্রদান করে । এছাড়া সাহিত্য-সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি একুশে পদক লাভ করেন । ১৯৭৬ সালের ১৪ই মার্চ কবি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন ।
পচান – পচে গেছে এমন । নামাজের ঘরে মোমবাতি মানে – নামাজের ঘর হলো মসজিদ, মোমবাতি মানে অর্থ হলো মোমবাতি দেওয়ার মানত করা । কোনো অসুখ- বিসুখ বা বিপদ-আপদ হলে এ দেশের মানুষ তা থেকে উদ্ধার পাওয়ার অভিপ্রায়ে এক ধরনের মানত করে । ‘নামাজের ঘরে মোমবাতি মানে' অর্থ হলো মসজিদে মোমবাতি দেওয়ার প্রতিজ্ঞা বা মানত করা । নয়ন নীর – নয়ন হলো চোখ, নীর হলো পানি, নয়নের নীর হলো চোখের পানি । রহিম চাচার ঝাড়া আমাদের দেশে রোগ-বালাই থেকে মুক্তি লাভের জন্য পানি পড়া, ঝাড়-ফুঁকের প্রচলন আছে। নানা ধরনের অসুখে অনেকে পানি পড়ে তা রুগীকে খেতে দেয়, রোগ থেকে মুক্তি লাভের উদ্দেশে । ‘রহিম চাচার ঝাড়া' মানে হলো রহিম চাচার সেই রকম একটি চিকিৎসা পদ্ধতি, যাতে ‘রহিম চাচা’ রুগী ছেলেটিকে ফুঁ দিয়ে সুস্থ করে তুলবে । আড়ঙের দিনে – আড়ং হলো হাট বা বাজার বা মেলা। আড়ঙের দিনে মানে হলো মেলার দিনে বা হাটের দিনে বা বাজারের দিনে ।
‘পল্লিজননী' কবিতাটি কবি জসীমউদদীনের রাখালী কাব্য থেকে সংকলন করা হয়েছে । মায়ের মতো মমতাময়ী আর কেউ নেই । রুগ্ণ পুত্রের শিয়রে বসে রাত জাগা এক মায়ের মনঃকষ্ট, পুত্রের চঞ্চলতা স্মরণ আর দারিদ্র্যের কারণে তাকে প্রয়োজনীয় খাদ্য ও আনন্দ-আয়োজন করতে না পারার ব্যর্থতা এ কবিতায় উল্লেখ করা হয়েছে । পুত্রের শিয়রে নিবুনিবু প্রদীপ, চারিদিকে মশার অত্যাচার, বেড়ার ফাঁক গলে আসে রাতের শীত । রুগ্ণ পুত্রের ঘুম স্বাভাবিকভাবেই আসে না । মা পুত্রকে আদর করে, তার রোগ ভালো করে দেবার জন্য দরগায় মানত করে । দুরন্ত ছেলে ভালো হয়েই খেলতে যাবে এবং তখন মা তাকে কিছু বলতে পারবে না, এমন অঙ্গীকার সে মায়ের কাছ থেকে আদায় করে নেয় । আবদারমুখো পুত্রের দিকে চেয়ে গ্রামীণ মায়ের মনে অনেক কথা জাগে । তার সামর্থ্য নেই বলে রোগীর ঔষধ, পথ্য কিছুই জোটাতে পারেনি । রুগ্ণ পরিবেশে রোগী সামনে নিয়ে এক পল্লিমায়ের মনে পুত্র হারানোর শঙ্কা জেগে ওঠে । অপত্যস্নেহের অনিবার্য আকর্ষণই এ কবিতার মূলকথা ।
আমারও মন চৈত্রে পলাতক,
পলাশে আর আমের ডালে ডালে
সবুজ মাঠে মাঝবয়সী লালে
দণ্ড দুই মুক্তি-সুখে জিরায়
মাটির কাছে সব মানুষ খাতক ।
বিভোল মনে অবাক চেয়ে থাকে
সারা দুপুর হেলাফেলার হীরায়,
উদাস মন হাওয়ার পাকে পাকে
ঘুঘুর ডাকে গ্রামের ফাঁকা ক্ষেতে
মিলিয়ে দেয় দুস্থতার পাতক,
বিকাল তাই সন্ধ্যা-রঙে মেতে শেষ,
যে শেষ সারাদিনের পরে
একটি গানে গহন স্বাক্ষরে ৷
জানো কি সেই গানের আমি চাতক?
বিষ্ণু দে ১৯০৯ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন । কলকাতার সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলে তাঁর শিক্ষা আরম্ভ হয়। ১৯৩২ সালে সেন্ট পলস কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বি.এ. সম্মান এবং ১৯৩৪ সালে এম. এ. ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি রিপন কলেজ, কৃষ্ণনগর কলেজ, মৌলানা আজাদ কলেজ ও প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন। ১৯২৩ সালে প্রকাশিত 'কল্লোল' পত্রিকাকে কেন্দ্র করে যে সাহিত্যিক গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটে, তিনি ছিলেন তাঁর অন্যতম কবি। অসাধারণ পাণ্ডিত্যের অধিকারী বিষ্ণু দে পুরাণ ও ঐতিহ্যের ব্যবহারে তাঁর কবিতাকে ভিন্ন এক মাত্রা দান করেন। বোধের তীক্ষ্ণতা, তীব্রতা ও জটিলতায় তাঁর কবিতা স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্য: উর্বশী ও আর্টেমিস, চোরাবালি, সাতভাই চম্পা, তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ, স্মৃতিসত্তা ভবিষ্যৎ, রবিকরোজ্জ্বল নিজদেশে, উত্তরে মৌন থাকো ইত্যাদি। সাহিত্য আকাদেমি ও জ্ঞানপীঠ পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় তিনি ভূষিত হন । ৩রা ডিসেম্বর ১৯৮২ সালে বিষ্ণু দে মৃত্যুবরণ করেন।
আমারও মন ... মুক্তি সুখে জিরায় - মানবমনে প্রকৃতির শাশ্বত আবেদন আছে। শহরে নগরে যেখানে সে বসবাস করুক না কেন, তার অবচেতনে লুকিয়ে থাকে প্রকৃতির চিরায়ত আহ্বান । আলোচ্য অংশে কবি হৃদয়ও পালিয়ে আনন্দ পায় চৈত্রের ঠা-ঠা রোদের আম-কাঁঠালের ডালে ডালে, সবুজ মাঠে মাঠে। মাঝবয়সী লাল – গাছ-পালার বয়স্ক পাতার রং বোঝাতে কবি এই চিত্রকল্পটি ব্যবহার করেছেন। বিভোল— অভিভূত, আত্মহারা, মুগ্ধ। দুস্থতার পাতক – শারীরিক ও মানসিক অশান্তি দূর করা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। চাতক— একপ্রকার পাখি। কবি কল্পনায় চাতক পাখি বৃষ্টির পানি ছাড়া অন্য পানি পান করে না ।
বিষ্ণু দে-র ‘একটি কাফি’ কবিতাটি কবির তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ কাব্য থেকে সংকলন করা হয়েছে। এটি একটি প্রকৃতিলগ্ন কবিতা। বাংলার নিসর্গ প্রকৃতি, এর মাঠ-ঘাট, মানুষ অতুলনীয় এবং বিশেষ আবেদনময়। যে জন এই নিসর্গ-প্রকৃতি থেকে নগরের আহ্বানে সেখানে স্থায়ী বসতি গড়েন, তাকেও তার এককালের পল্লিপ্রকৃতি বারবার আকর্ষণ করে; ষড়ঋতু তার মনে আবেগের রংধনু তোলে। এর শাশ্বত কারণ হলো, মানুষ স্বভাবত তার নিজভূমের প্রতি ঋণী হয় । কবি নিজেও তৃষ্ণার্ত চাতক পাখির মতো তাঁর নিজভূমের পল্লিপ্রকৃতির জন্য অপেক্ষমাণ। কবিতায় নিসর্গ প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের একাত্মতাই উন্মোচিত হয়েছে।
সূর্য-ঝলকে! মৌসুমী ফুল ফুটে
স্নিগ্ধ শরৎ আকাশের ছায়া লুটে
পড়ে মাঠভরা ধান্য শীর্ষ পরে
দেশের মাটিতে মানুষের ঘরে ঘরে।
আমার দেশের মাটিতে আমার প্রাণ
নিতি লভে নব জীবনের সন্ধান
এখানে প্লাবনে নুহের কিতি ভাসে
শান্তি-কপোত বারতা লইয়া আসে।
জেগেছে নতুন চর
সেই চরে ফের মানুষেরা সব পাশাপাশি বাঁধে ঘর।
নব অঙ্কুর জাগে—
প্রতি দিবসের সূর্য-আলোকে অন্তর অনুরাগে
আমার দেশের মাটিতে মেশানো আমার প্রাণের ঘ্রাণ
গৌরবময় জীবনের সম্মান ।
প্রাণ-স্পন্দনে লক্ষ তরুর করে
জীবনপ্রবাহ সঞ্চারি মর্মরে
বক্ষে জাগায়ে আগামী দিনের আশা
আমার দেশের এ মাটি মধুর, মধুর আমার ভাষা
আমার দেশ নদীতে নদীতে মিলে হেথা গিয়ে ধায় সাগরের পানে
মানুষে মানুষে মিলে গিয়ে প্রাণে প্রাণে
সূর্য চন্দ্র করে
মৌসুমী ফুলে অঞ্জলি ভরে ভরে
আপন দেশের মাটিতে দাঁড়ায়ে হাসে
সূর্য-ঝলকে ! জীবনের ডাক আসে
সেই ডাকে দেয় সাড়া
নদী-প্রান্তর পার হয়ে আসে লক্ষ প্রাণের ধারা
মিলিতে সবার সনে
আমার দেশের মানুষেরা সবে মুক্ত-উদার মনে
আর্ত-ব্যথিত সুধী গুণীজন পাশে
সেবা-সাম্য-প্রীতি বিনিময় আশে
সূর্য-আলোকে আবার এদেশে হাসে
নিতি নবরূপে ভরে ওঠে মন জীবনের আশ্বাসে ।
সুফিয়া কামাল ১৯১১ সালের ২০শে জুন বরিশাল জেলার শায়েস্তাবাদে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ আবদুল বারী ও মাতার নাম সৈয়দা সাবেরা খাতুন। তিনি কুমিল্লার বাসিন্দা ছিলেন। প্রতিকূল পরিবেশে বসবাস করেও বাংলা ভাষা চর্চায় তিনি ছিলেন গভীর অনুরাগী। '৫২-র ভাষা আন্দোলন থেকে '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তীকালের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি অসামান্য ভূমিকা রাখেন। একটি প্রগতিশীল সমাজ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আজীবন যুদ্ধ করেছেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর কবিতা লেখার হাতেখড়ি হয় এবং তাঁর কবিতা সমসাময়িক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে। পারিবারিক জীবনের নানা বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও তাঁর কাব্যচর্চা অব্যাহত থাকে। তিনি কিছুকাল কলকাতার একটি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তাঁর কবিতার ভাষা সহজ সরল, ছন্দ সুললিত ও ব্যঞ্জনাময় । এই কর্মের স্বীকৃতির জন্য তাঁকে বাংলাদেশের জনগণ ‘জননী সাহসিকা' অভিধায় অভিষিক্ত করেছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্য: সাঁঝের মায়া, মায়া কাজল, উদাত্ত পৃথিবী, মন ও জীবন, মৃত্তিকার ঘ্রাণ এবং গল্পগ্রন্থ : কেয়ার কাঁটা; স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ : একাত্তরের ডাইরী; শিশুতোষ গ্রন্থ : ইতল বিতল ও নওল কিশোরের দরবারে। সাহিত্যকর্মে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, Women's Federation for World Peace Crest-সহ অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০শে নভেম্বর ১৯৯৯ সালে এই মহীয়সী নারী মৃত্যুবরণ করেন ।
সূর্য—ঝলকে- সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত, উদ্ভাসিত। মৌসুমী ফুল—বিশেষ ঋতুতে (সময়ে) উৎপন্ন ফুল। স্নিগ্ধ শরৎ- শরৎকালের উজ্জ্বলতা। ধান্য শীর্ষ-ধানের ওপর ভাগ। নূহের কিশতি— সেমিটিক পুরাণ অনুসারে পৃথিবীতে মহাপ্লাবনের সময়ে একজন নবির যে বড় নৌকা সবাইকে রক্ষা করেছিল।
শান্তি –কপোত— শান্তির কবুতর, কবুতরকে শান্তির প্রতীক বলা হয়। বারতা—সংবাদ, বার্তা ।
সুফিয়া কামালের উদাত্ত পৃথিবী কাব্যের 'আমার দেশ' কবিতাটি ‘সুফিয়া কামাল রচনাসংগ্রহ' থেকে সংকলন করা হয়েছে। বাঙালির সোনার বাংলা অসম্ভবকে সম্ভব করে, মাটি থেকে জন্ম দেয় সোনালি ফসল। চমৎকার এর জলবায়ু— সহনীয় রৌদ্রতাপ, নমনীয় জল-বৃষ্টি তাই এর মাঠ ভরে ওঠে সোনালি ধানে, সবুজ পাটে, নানা বর্ণের ফলমূলে। এদেশের মানুষ পাশাপাশি ঘর বেঁধে তাই শান্তিতে বাস করে । দুর্যোগও যে আসে না তা নয়। কিন্তু দুর্যোগের সময় ও তা অতিক্রান্ত হওয়ামাত্র তারা আবার ঘর বাঁধে পাশাপাশি, থাকে শান্তিতে। বাংলার মানুষের মধুর ভাষা, অপার জীবনানন্দ তাদের নিয়ে যায় সম্প্রীতির মহাসাগরে। আকাশে যেমন সূর্য ওঠে, তেমনি ডাক আসে মিলনের । এদেশের মানুষ পরস্পরে মহামিলনের মধ্যেই প্রত্যহ নতুন হয়ে ওঠে। কবিতায় চিরায়ত বাংলার জীবনবাণী অসাধারণভাবে ধরা পড়েছে।
আমি সেই জগতে হারিয়ে যেতে চাই,
যেথায় গভীর-নিশুত রাতে
জীর্ণ বেড়ার ঘরে
নির্ভাবনায় মানুষেরা ঘুমিয়ে থাকে ভাই ॥
যেথায় লোকে সোনা-রূপায়
পাহাড় জমায় না,
বিত্ত-সুখের দুর্ভাবনায়
আয়ু কমায় না;
যেথায় লোকে তুচ্ছ নিয়ে
তুষ্ট থাকে ভাই ॥
সারা দিনের পরিশ্রমেও
পায় না যারা খুঁজে
একটি দিনের আহার্য সঞ্চয়,
তবু যাদের মনের কোণে
নেই দুরাশা গ্লানি,
নেই দীনতা, নেই কোনো সংশয় ৷
যেথায় মানুষ মানুষেরে
বাসতে পারে ভালো
প্রতিবেশীর আঁধার ঘরে
জ্বালতে পারে আলো,
সেই জগতের কান্না-হাসির
অন্তরালে ভাই
আমি হারিয়ে যেতে চাই ॥
খুলনা জেলার তেঁতুলিয়া গ্রামে ১৯১৯ সালের ১৯শে মার্চ সিকান্দার আবু জাফর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সৈয়দ মঈনুদ্দীন হাশেমী পেশায় ছিলেন কৃষিজীবী ও ব্যবসায়ী । সিকান্দার আবু জাফর ১৯৩৬ সালে তালা বি. দে. ইনস্টিটিউশন থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং কলকাতার রিপন কলেজ থেকে আই. এ. পাস করেন। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন সাংবাদিক। দেশ বিভাগের পরে তিনি স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস করেন। এ সময় তিনি রেডিও পাকিস্তানে চাকরি থেকে শুরু করে দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক মিল্লাত, মাসিক সমকাল প্রভৃতি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘ছয় দফা আন্দোলন'কে বেগবান করে তোলার জন্য তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি ছিলেন একজন একনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক কর্মী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর লেখা ‘আমাদের সংগ্রাম চলবেই চলবে' গানটি স্বাধীনতাকামী বাঙালি জাতিকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। তাঁর গণসঙ্গীত ও কবিতা মেহনতি মানুষের মুক্তির প্রেরণায় সমৃদ্ধ। সিকান্দার আবু জাফরের উল্লেখযোগ্য কাব্য: প্রসন্ন শহর, বৈরী বৃষ্টিতে, তিমিরান্তিক, বৃশ্চিক লগ্ন, মালব কৌশিক ইত্যাদি। সাহিত্যকর্মে অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও একুশে পদকে (মরণোত্তর) ভূষিত হন। ৫ই আগস্ট ১৯৭৫ সালে সিকান্দার আবু জাফর মৃত্যুবরণ করেন ।
আমি সেই জগতে...ঘুমিয়ে থাকে ভাই কে কীভাবে সুখী হবে তা নির্ধারিত নয়। - মানুষ গতানুগতিক যেভাবে সুখী হয় কবি সেভাবে সুখী হওয়ার কথা এখানে বলেননি। সুখের চিন্তায় মানুষের রাতে ঘুম হয় না। কিন্তু সুখী মানুষের ঘুমের সমস্যা হয় না। সারাদিন কাজের পর বিছানায় গেলেই শান্তির ঘুম তাকে তৃপ্তি দেয়। কবিও তেমনি সে রকম এক জীবন-যাপনের মাঝে যেতে চান যেখানে ভাঙা বেড়ার ঘরেও মানুষ নির্ভাবনায় ঘুমিয়ে থাকে; ঘুমিয়ে যেতে পারে।
বিত্ত-সুখের ... কমায় না – সমাজের - বেশির ভাগ মানুষ টাকা-পয়সা ও সম্পদের লোভে দিনাতিপাত করে; এতে সুখ হারাম হয়ে যায়; জীবন হয় যন্ত্রণাময় । এতে তাদের জীবন দীর্ঘ না হয়ে বিভিন্ন রোগ-বালাইয়ে তারা আক্রান্ত হয় এবং মৃত্যুবরণ করে। বিত্ত-সুখের দুর্ভাবনা মানুষকে সুখ তো দেয়ই না বরং তাদের আয়ু আরও কমে যায়।
যেথায় মানুষ ... জ্বালতে পারে আলো – জীবনের সার্থকতা কোথায় এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কিছু মানুষ আছে যারা অন্যের উপকার ও মঙ্গলের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে। মানবপ্রেম বা মানুষকে ভালোবাসতে পারার মাঝে জীবনের মহত্ত্ব নিহিত থাকে। প্রতিবেশীর দুঃখে এগিয়ে আসা, তাদের দুঃখ-কষ্ট দূর করার মাঝেও এক ধরনের তৃপ্তি আছে। কবি তাই বলেছেন যে, যেখানে মানুষকে ভালোবাসা যায়, প্রতিবেশীর দুঃখ-কষ্ট দূর করে আলো জ্বালানো যায়— সেখানেই তিনি থাকতে চান ।
সিকান্দার আবু জাফরের মালব কৌশিক কাব্য থেকে কবিতাটি সংকলিত হয়েছে। জাগতিক এই পৃথিবী ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে। মানুষ ক্রমশ আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। মানুষের সঙ্গে মানুষের বাড়ছে ব্যবধান। কারও মনেই যেন শান্তি নেই। বিত্ত-বৈভব অর্জন করা আর সুখের দুর্ভাবনায় তাদের আয়ু কমে যাচ্ছে। কিন্তু কবি এসব অতিক্রম করে যেতে চাইছেন সেইসব মানুষের কাছে যারা প্রকৃত অর্থেই মানুষ । মনুষ্যত্বের আলো যারা জ্বালিয়ে রেখেছেন। দরিদ্র হলেও এই মানুষ বিত্তের পেছনে ছোটে না ৷ সোনা-রুপার পাহাড় গড়ে তোলে না। জীর্ণ ঘরে বসবাস করেও তারা সুখী। তুচ্ছ, ছোটো ছোটো আনন্দ অবগাহনেই কাটে তাদের দিন। সারাদিন তারা হাড়ভাঙা খাটুনি খাটে, তাতে হয়তো একটি দিনের আহার্যও জোটে না । তবু কোনো দুরাশা বা গ্লানি তাদের গ্রাস করে না। কোনো দীনতা বা সংশয়ে তাদের জীবন ক্লিষ্ট নয়। বরং দারিদ্র্যের মধ্যে থেকেও তারা মানুষকে ভালোবাসতে পারে। প্রতিবেশীকে সাহায্য করে। কবি মনুষ্যত্বের অধিকারী এসব মানুষের সান্নিধ্য পেতে চাইছেন, হারিয়ে যেতে চাইছেন তাদের মাঝে । তিনি মনে করেন, এরাই হচ্ছে সত্যিকারের মানুষ। কবিতাটিতে গণমানুষের প্রতি একাত্মতা, মানবিকতা ও মনুষ্যত্বের সুগভীর সংবেদনা প্রতিফলিত হয়েছে।
বৃষ্টি এলো ... বহু প্রতীক্ষিত বৃষ্টি ! – পদ্মা মেঘনার
দুপাশে আবাদি গ্রামে, বৃষ্টি এলো পূবের হাওয়ায়,
বিদগ্ধ আকাশ, মাঠ ঢেকে গেল কাজল ছায়ায়;
বিদ্যুৎ-রূপসী পরী মেঘে মেঘে হয়েছে সওয়ার।
দিকদিগন্তের পথে অপরূপ আভা দেখে তার
বর্ষণ-মুখর দিনে অরণ্যের কেয়া শিহরায়,
রৌদ্র-দগ্ধ ধানক্ষেত আজ তার স্পর্শ পেতে চায়,
নদীর ফাটলে বন্যা আনে পূর্ণ প্রাণের জোয়ার।
রুণ বৃদ্ধ ভিখারির রগ-ওঠা হাতের মতন
রুক্ষ মাঠ আসমান শোনে সেই বর্ষণের সুর,
তৃষিত বনের সাথে জেগে ওঠে তৃষাতপ্ত মন,
পাড়ি দিয়ে যেতে চায় বহু পথ, প্রান্তর বন্ধুর,
যেখানে বিস্তৃত দিন পড়ে আছে নিঃসঙ্গ নির্জন
সেখানে বর্ষার মেঘ জাগে আজ বিষণ্ন মেদুর ॥
ফররুখ আহমদ ১৯১৮ সালের ১০ই জুন মাগুরা জেলার মাঝআইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর পিতা খান সাবের সৈয়দ হাতেম আলী। ফররুখ আহমদ কলকাতা রিপন কলেজ থেকে আই. এ. পাস করেন এবং কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে দর্শনে অনার্স ও ইংরেজিতে অনার্সের ছাত্র ছিলেন। কিন্তু পরীক্ষা না দিয়েই কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। কর্মজীবনে তিনি নানা পদে নিয়োজিত হন এবং ১৯৪৭ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বেতারে স্টাফ রাইটার পদে নিয়োজিত ছিলেন। ইসলামি আদর্শ ও ঐতিহ্য তাঁকে কাব্যসৃষ্টিতে প্রেরণা জুগিয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : সাত সাগরের মাঝি, সিরাজাম মুনীরা, নৌফেল ও হাতেম, মুহূর্তের কবিতা, পাখির বাসা, হাতেমতায়ী, নতুন লেখা, হরফের ছড়া, ছড়ার আসর ইত্যাদি । সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আদমজী পুরস্কার, একুশে পদকসহ (মরণোত্তর) অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৭৪ সালের ১৯শে অক্টোবর তিনি পরলোকগমন করেন।
বিদ্যুৎ রূপসী পরী – বিদ্যুৎ চমকানোকে লোকজ ধারণা অনুযায়ী সুন্দরী পরীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে যে মেঘে মেঘে ঘুরে বেড়ায়।
সওয়ার – আরোহী।
রুগ্ণ বৃদ্ধ ভিখারির ... তৃষ্ণাতপ্ত মন – দীর্ঘ বর্ষণহীন দিনে মাঠঘাট শুকিয়ে যে রুক্ষ মূর্তি ধারণ করেছে কবি তাকে রুগ্ণ বৃদ্ধ ভিখারির রগ-ওঠা হাতের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এখন বর্ষণের শুরুতে তৃষ্ণাকাতর মাঠ-ঘাট ও বনে দেখা দিয়েছে প্রাণের জোয়ার।
তৃষাতপ্ত – পিপাসায় কাতর। বিষণ্ণ মেদুর – বৃষ্টিবিহীন প্রকৃতির রুক্ষতা বৃষ্টির আগমনে দূরীভূত হয়েছে। প্রকৃতি এখন স্নিগ্ধকোমল হয়ে চারিদিক করে তুলেছে প্রাণোচ্ছ্বল ।
‘বৃষ্টি' কবিতাটি ফররুখ আহমদের মুহূর্তের কবিতা কাব্য থেকে সংকলিত হয়েছে। কৃষিপ্রধান বাংলার বহুপ্রতীক্ষিত বৃষ্টি নিয়ে কবিতাটি লিখিত। প্রকৃতিতে বর্ষা আসে প্রাণস্পন্দন নিয়ে। আর বৃষ্টিই বর্ষার প্রাণ। এ সময় নদীর দু-ধারে প্লাবন দেখা দেয়, ফলে পলিমাটির গৌরবে ফসল ভালো হয়। বৃষ্টির সময় আকাশের সর্বত্র মেঘের খেলা দেখা যায়, বর্ষার ফুল ফুটে সর্বত্র মোহিত হয়, রুক্ষ মাটি বৃষ্টিতে প্রাণ জুড়ায়। বৃষ্টির দিনে সংবেদনশীল মানুষও রসসিক্ত হয়ে ওঠে। তার মনে পড়ে সুখময় অতীত, পুরনো স্মৃতি, আর সে ভালোলাগার আলপনা আঁকে মনে মনে । এ বৃষ্টি কখনো বিষণ্নও করে মন, একাকী জীবনে বাড়ায় বিরহ। সুতরাং বৃষ্টি শুধু প্রাকৃতিক ঘটনা বা প্রাকৃতিক পালাবদলের নিয়ামক নয়, এর সঙ্গে ব্যক্তির জীবনও কতটা সম্পৃক্ত তারই কাব্যরূপটি কবিতায় ফুটে উঠেছে।
আসমানের তারা সাক্ষী
সাক্ষী এই জমিনের ফুল, এই
নিশিরাইত বাঁশবাগান বিস্তর জোনাকি সাক্ষী
সাক্ষী এই জারুল জামরুল, সাক্ষী
পুবের পুকুর, তার ঝাকড়া ডুমুরের ডালে স্থির দৃষ্টি
মাছরাঙা আমাকে চেনে
আমি কোনো অভ্যাগত নই
খোদার কসম আমি ভিনদেশি পথিক নই
আমি কোনো আগন্তুক নই ।
আমি কোনো আগন্তুক নই, আমি
ছিলাম এখানে, আমি স্বাপ্নিক নিয়মে
এখানেই থাকি আর
এখানে থাকার নাম সর্বত্রই থাকা
সারা দেশে।
আমি কোনো আগন্তুক নই ৷
এই খর রৌদ্র জলজ বাতাস মেঘ ক্লান্ত বিকেলের
পাখিরা আমাকে চেনে
তারা জানে আমি কোনো অনাত্মীয় নই ।
কার্তিকের ধানের মঞ্জরী সাক্ষী
সাক্ষী তার চিরোল পাতার
টলমল শিশির – সাক্ষী জ্যোৎস্নার চাদরে ঢাকা
নিশিন্দার ছায়া
অকাল বার্ধক্যে নত কদম আলী
তার ক্লান্ত চোখের আঁধার –
আমি চিনি, আমি তার চিরচেনা স্বজন একজন । আমি
জমিলার মা'র
শূন্য খা খা রান্নাঘর শুকনো থালা সব চিনি
সে আমাকে চেনে।
হাত রাখো বৈঠায় লাঙলে, দেখো
আমার হাতের স্পর্শ লেগে আছে কেমন গভীর । দেখো
মাটিতে আমার গন্ধ, আমার শরীরে
লেগে আছে এই স্নিগ্ধ মাটির সুবাস।
আমাকে বিশ্বাস করো, আমি কোনো আগন্তুক নই ।
দু'পাশে ধানের খেত
সরু পথ
সামনে ধু ধু নদীর কিনার
আমার অস্তিত্বে গাঁথা । আমি এই উধাও নদীর
মুগ্ধ এক অবোধ বালক ৷
আহসান হাবীব ১৯১৭ সালের ২রা জানুয়ারি পিরোজপুর জেলার শঙ্করপাশা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে আইএ পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। কর্মজীবনে তিনি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। গভীর জীবনবোধ ও আশাবাদ তাঁর কবিতাকে বিশিষ্ট ব্যঞ্জনা দান করেছে। তাঁর কবিতার স্নিগ্ধতা পাঠকচিত্তে এক মধুর আবেশ সৃষ্টি করে। তিনি সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং আর্তমানবতার পক্ষে বক্তব্য রেখেছেন। তাঁর প্রথম কাব্য রাত্রিশেষ। এ ছাড়া ছায়াহরিণ, সারা দুপুর, আশায় বসতি, মেঘ বলে চৈত্রে যাবো তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্য। ছোটোদের জন্য তাঁর কবিতার বই জোছনা রাতের গল্প ও ছুটির দিন দুপুরে। রানী খালের সাঁকো তাঁর কিশোরপাঠ্য উপন্যাস। আহসান হাবীব তাঁর সাহিত্যকর্মের জন্য বাংলা একাডেমি ও একুশে পদক পুরস্কার লাভ করেন। দৈনিক বাংলা পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক থাকাকালে ১৯৮৫ সালের ১০ই জুলাই তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
আসমান – আকাশ। সাক্ষী – কোনো কিছু নিজচোখে দেখেছেন এমন কেউ। জমিন- ভূমি।
নিশিরাইত – ‘নিশীথ রাত্রি’র গ্রামীণ কথ্যরূপ (গভীর রাত বোঝাতে)।
অভ্যাগত – গৃহে এসেছে এমন ব্যক্তি, আগন্তুক, নিমন্ত্রিত অতিথি।
ধানের মঞ্জরী – মঞ্জরী হলো মুকুল বা শিষ, ধানের মঞ্জরী হলো ধানের শিষ বা মুকুল।
নিশিন্দা – গ্রামীণ এক ধরনের গাছ।
জমিলার মা'র...সব চিনি - গরিব, অভাবী শ্রেণির প্রতিনিধি জমিলার মা। তাদের রান্নাঘর শূন্যই থাকে সাধারণত। কারণ রান্না সব চিনি করার খাদ্য উপাদান তাদের নেই। যেহেতু রান্না করা হয় না, খাবারও খাওয়া হয়ে ওঠে না। তাই থালা-বাসনও শুকনো থাকে। কবিও সেই অবস্থার কথা জানেন।
স্নিগ্ধ মাটির সুবাস - মাটির মিষ্টি গন্ধ । অর্থাৎ মায়াবী ও আকর্ষণীয় গ্রামবাংলা ।
দু'পাশে ধানের ক্ষেত ... আমার অস্তিত্বে গাঁথা – কবি গ্রামীণ জীবনেই বেড়ে উঠেছেন। গ্রামের মাঠ-ঘাট পথ-প্রান্তরের মতো ক্ষেতের সরু পথ, তার পাশে ধানের সমারোহ এবং একটু এগিয়ে গেলে বিশাল নদীর কিনার কবির মনের ভেতর, অস্থি-মজ্জায় গ্রথিত হয়ে আছে। এরা সবাই কবির খুবই চেনা-জানা ।
জন্মভূমির সঙ্গে মানুষের আজীবনের সম্পর্ক। এর সবকিছুই তার মনে হয় কত চেনা, কত জানা। জন্মভূমির মধ্যে শিকড় গেড়ে থেকেই মানুষ তাই সমগ্র দেশকে আপন করে পায়। এই অনুভূতি তুলনাহীন। দেশ মানে তো শুধু চারপাশের প্রকৃতি নয়, একে আপন সত্তায় অনুভব করা। আর দেশকে অনুভব করলেই দেশের মানুষকেও আপন মনে হবে আমাদের। এই কবিতায় বাংলা সাহিত্য
সেই অনুভবই আন্তরিক মমতায় সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন কবি। তিনি উচ্চারণ করছেন, তিনি কোনো আগন্তুক নন । তিনি যেমন ওই আসমান, জমিনের ফুল, জোনাকি, পুকুর, মাছরাঙাকে চেনেন, তেমনি তারাও তাকে চেনে । পাখি, কার্তিকের ধান কিংবা শুধু শিশির নয়, তিনি এই জনপদের মানুষকেও ভালোভাবে চেনেন। তিনি কদম আলী, জমিলার মা'র মতো মানুষের চিরচেনা স্বজন। কবি অনুভব করেন, যে-লাঙল জমিতে ফসল ফলায়, সেই লাঙল আর মাটির গন্ধ লেগে আছে তার হাতে, শরীরে। ধানক্ষেত আর ধু ধু নদীর কিনার, অর্থাৎ এই গ্রামীণ জনপদের সঙ্গেই তার জীবন বাঁধা । এই হচ্ছে তাঁর অস্তিত্ব। এই হচ্ছে মানবজীবন, জন্মভূমির সঙ্গে যে-মানুষ গভীরভাবে সম্পর্কিত ।
প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,
চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য
কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া ।
চিমনির মুখে শোনো সাইরেন-শঙ্খ,
গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে
তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য
জীবনকে চায় ভালোবাসতে ।
শতাব্দীলাঞ্ছিত আর্তের কান্না
প্রতি নিঃশ্বাসে আনে লজ্জা;
মৃত্যুর ভয়ে ভীরু বসে থাকা, আর না-
পরো পরো যুদ্ধের সজ্জা ।
প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা,
দুর্যোগ পথ হয় হোক দুর্বোধ্য
চিনে নেবে যৌবন-আত্মা ।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় ১৯১৯ সালে ভারতের নদীয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্য হলো : পদাতিক, অগ্নিকোণ, চিরকুট। তাঁর অনূদিত কাব্যগুলো হলো “নাজিম হিকমতের কবিতা', ‘পাবলো নেরুদার কবিতাগুচ্ছ', । ‘হাংরাস' ও ‘কে কোথায় যায় এ দুটি তাঁর লেখা উপন্যাস । চিন্তা-চেতনায় ও লেখনিতে তিনি মেহনতি মানুষের মুক্তির সংগ্রামকে ধারণ করতেন।
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। উল্লেখযোগ্য পুরস্কারগুলো হলো : আকাদেমি পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, সোভিয়েত ল্যান্ড নেহরু পুরস্কার । তিনি ২০০৩ সালে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন ।
প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য - পৃথিবীতে ধনীরা আরাম-আয়েশে থাকে । গরিবেরা, বঞ্চিতরা কষ্টে থাকে । কবি চান ধনী-গরিবের ভেদ দূর হোক । কিন্তু তার জন্য দরিদ্ররা-শোষিত বঞ্চিতরা সচেতন না হলে শোষণ থেকে তারা মুক্তি পাবে না । তার জন্য তাদের সংগ্রাম করতে হবে । তাই ‘ফুল খেলা' অর্থাৎ অসচেতনভাবে চলতি আনন্দে গা-ভাসিয়ে দেয়াটা শোষিত-বঞ্চিতের জন্য উচিত হবে না । অদ্য- অর্থাৎ বর্তমানটা ভীষণ কষ্টের ।তাই কবি তাদের সচেতন হতে এবং সংগ্রাম করতে বলেছেন ।
সেঁকে -ভেজে ।
সাইরেন -বিপদ সংকেত ।
শতাব্দী -শত অব্দ বা শত বৎসর।
লাঞ্ছিত -নিপীড়িত, অত্যাচারিত।
আর্ত -পীড়িত ।
বার্তা -খবর ।
যৌবন আত্মা -বলিষ্ঠ আত্মা; সাহস আছে এমন তরুণ ।
‘মে দিনের কবিতা' সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পদাতিক কাব্য থেকে সংকলিত হয়েছে। বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে রোমান্টিকতার পথ পরিহার করে সংগ্রামের পথে এগিয়ে আসার আহ্বান উচ্চারিত হয়েছে কবিতায় । ফুল খেলা আর বিলাসী জীবন যাপনের দিন আর নেই। এখন সকলকে এগিয়ে আসতে হবে সংগ্রামের পথে। সে-পথ কঠিন, সে-পথ দুর্গম, বড় বেশি কঠোর। তবু কবি সে-পথেই আহ্বান জানিয়েছেন তার প্রিয় মানুষকে । শোষক-নির্যাতক-অত্যাচারীর হাত থেকে মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রামের কথা ব্যক্ত হয়েছে এ কবিতায় । শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে-নির্মম শোষণ চলেছে, আজ তা প্রতিহত করার দিন এসেছে । তাই কবি মুক্তির পথে, সংগ্রামের পথে, সকলকে একাত্ম হতে আহ্বান জানিয়েছেন ।
জেনেছি সত্য বহু দিন মনে
মনে মুক্তির পথ মিশে গেছে জনগণে,
যেখানে লক্ষ লোকের রুক্ষ হাত
সৃষ্টির মাঝে নিয়োজিত দিনরাত,
যেখানে মানুষ দৈনন্দিন কাজে
প্রাণপাত করে দুঃস্বপ্নের মাঝে,
মাটিতে শিকড় গেড়ে যারা বেঁচে আছে,
আধমরা হয়ে পাষাণের রসে বাঁচে,
সেই জনতার দীপ্ত মিছিল ধরে
নবযুগ আসে রক্ত দিনের ভোরে।
আবুল হোসেন ১৫ই আগস্ট ১৯২২ সালে খুলনা জেলার ফকিরহাট থানার আডুডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা এস.এম. ইসমাইল হোসেন। আবুল হোসেন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতি বিষয়ে বি.এ. সম্মান ও এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি বাংলাদেশ সরকারের তাঁর যুগ্ম সচিব পদ থেকে অবসর গ্রহণ করে ঢাকায় বসবাস করতেন। তাঁর কবিতায় দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধের স্বচ্ছন্দ প্রকাশ ঘটেছে । চিত্রময়তা ও শব্দের প্রয়োগকুশলতা তাঁর কবিতাকে বিশিষ্টতা দান করেছে। উল্লেখযোগ্য কাব্য হচ্ছে : নববসন্ত, বিরস সংলাপ, হাওয়া তোমার কী দুঃসাহস, দুঃস্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্ন ইত্যাদি। ইকবালের কবিতা, বিভিন্ন ভাষার কবিতা, অন্য ক্ষেতের ফসল ইত্যাদি তাঁর অনুবাদ কাব্য। আবুল হোসেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, পদাবলী পুরস্কারসহ প্রচুর পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। ২০১৪ সালের ২৯ জুন তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
জেনেছি সত্য ..... গেছে জনগণে – ‘জেনেছি সত্য' হলো এক ধরনের বিশ্বাস যা বহুদিন ধরে - মনের মাঝে কবি বহন করে চলেছেন। আর সে বিশ্বাসটি হলো মানুষের মুক্তির পথ জনগণের মাঝেই মিশে আছে। ‘জনগণ' বলতে সাধারণ খেটে-খাওয়া, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষকে বোঝানো হয়েছে। সেই জনগণের ভেতর থেকেই মুক্তির সোপান বেরিয়ে আসবে।
আধমরা হয়ে পাষাণের রসে বাঁচে - সমাজের খেটে-খাওয়া মানুষ, যাদের কর্মযজ্ঞেই এই পৃথিবী এত সুন্দর
সেই মানুষেরা সমাজে দু'বেলা খেতে পায় না, তাদের জীবনে কোনো রস নেই, বৈচিত্র্য নেই, যেন পাষাণের
মতো বা পাথরের মতো নীরস তাদের জীবন।
সেই জনতার দীপ্ত ... রক্ত দিনের ডোরে – খেটে খাওয়া মানুষ, জনতা নিজেদের ভাগ্যকে নিজেদের হাতে বদলানোর জন্য একদিন সোচ্চার হয়ে ওঠে, বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, রাজপথে নেমে আসে, মিছিল করে- এভাবে এক বৈপ্লবিক অবস্থার সৃষ্টি যখন করে তখনই নতুন যুগের সৃষ্টি হয়; সকল অত্যাচার নির্যাতন দূর হয়।
এই সভ্যতা গড়ে উঠেছে শ্রমজীবী ও মেহনতি মানুষের পরিশ্রমের কারণে । যেখানে লক্ষ হাত একত্রিত হয় সেখানেই শক্তি দৃঢ়তর হয়; সেখানেই সৃষ্টির নতুন পথ হয় রচিত।যে মানুষ দুঃস্বপ্নের মধ্যেও দিনরাত কাজ করে, যারা শত বাধাকে উপেক্ষা করে মা ও মাটির টানে দেশের হিতার্থে নিয়োজিত, যারা অর্ধাহার-অনাহারেও দেশত্যাগ করে অন্যত্র চিরদিনের মতো চলে যায় না তারাই প্রকৃত দেশপ্রেমী। সেই শ্রমজীবী, মেহনতি সাধারণ মানুষের কাতারে মিশে গেলেই জীবনের প্রকৃত আনন্দ পাওয়া সম্ভব। কবি মনে করেন, এটাই মুক্তির মৌল সত্য। কবিতাটিতে মানবমুক্তি ও প্রগতির চিরন্তন সে সত্যরূপ প্রকাশিত হয়েছে।
রানার ছুটেছে তাই ঝুম্ঝুম্ ঘণ্টা বাজছে রাতে
রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে,
রানার চলেছে, রানার!
রাত্রির পথে পথে চলে কোনো নিষেধ জানে না মানার ।
দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার -
কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার ।
রানার ! রানার !
জানা-অজানার
বোঝা আজ তার কাঁধে,
বোঝাই জাহাজ রানার চলেছে চিঠি আর সংবাদে;
রানার চলেছে, বুঝি ভোর হয় হয়,
আরো জোরে, আরো জোরে, এ রানার দুর্বার দুর্জয়।
তার জীবনের স্বপ্নের মতো পিছে সরে যায় বন,
আরো পথ, আরো পথ – বুঝি হয় লাল ও পূর্ব কোণ ।
অবাক রাতের তারারা, আকাশে মিটমিট করে চায়;
কেমন করে এ রানার সবেগে হরিণের মতো যায়!
কত গ্রাম কত পথ যায় সরে সরে -
শহরে রানার যাবেই পৌঁছে ভোরে;
হাতে লণ্ঠন করে ঠনঠন, জোনাকিরা দেয় আলো
মাভৈঃ রানার ! এখনো রাতের কালো ।
এমনি করেই জীবনের বহু বছরকে পিছু ফেলে,
পৃথিবীর বোঝা ক্ষুধিত রানার পৌঁছে দিয়েছে ‘মেলে'।
ক্লান্তশ্বাস ছুঁয়েছে আকাশ, মাটি ভিজে গেছে ঘামে
জীবনের সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে ।
অনেক দুঃখে, বহু বেদনায়, অভিমানে, অনুরাগে,
ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে ।
রানার! রানার!
এ বোঝা টানার দিন কবে শেষ হবে?
রাত শেষ হয়ে সূর্য উঠবে কবে?
ঘরেতে অভাব; পৃথিবীটা তাই মনে হয় কালো ধোঁয়া,
পিঠেতে টাকার বোঝা, তবু এই টাকাকে যাবে না ছোঁয়া,
রাত নির্জন, পথে কত ভয়, তবুও রানার ছোটে,
দস্যুর ভয়, তারো চেয়ে ভয় কখন সূর্য ওঠে ।
কত চিঠি লেখে লোকে-
কত সুখে, প্রেমে, আবেগে, স্মৃতিতে, কত দুঃখে ও শোকে ।
এর দুঃখের চিঠি পড়বে না জানি কেউ কোনো দিনও,
এর জীবনের দুঃখ কেবল জানবে পথের তৃণ,
এর দুঃখের কথা জানবে না কেউ শহরে ও গ্রামে,
এর কথা ঢাকা পড়ে থাকবেই কালো রাত্রির খামে।
দরদে তারার চোখ কাঁপে মিটিমিটি,-
এ-কে যে ভোরের আকাশ পাঠাবে সহানুভূতির চিঠি-
রানার! রানার! কী হবে এ বোঝা বয়ে?
কী হবে ক্ষুধার ক্লান্তিতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে?
রানার! রানার! ভোর তো হয়েছে – আকাশ হয়েছে লাল
আলোর স্পর্শে কবে কেটে যাবে এই দুঃখের কাল?
রানার! গ্রামের রানার!
সময় হয়েছে নতুন খবর আনার;
শপথের চিঠি নিয়ে চলো আজ
ভীরুতা পিছনে ফেলে -
পৌঁছে দাও এ নতুন খবর,
অগ্রগতির ‘মেলে’,
দেখা দেবে বুঝি প্রভাত এখুনি-
নেই, দেরি নেই আর,
ছুটে চলো, ছুটে চলো, আরো বেগে
দুর্দম, হে রানার ॥
সুকান্ত ভট্টাচার্য ৩০শে শ্রাবণ ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে কলকাতার কালীঘাটে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায়। তাঁর পিতা নিবারণচন্দ্র ভট্টাচার্য এবং মাতা সুনীতি দেবী। সুকান্ত বেলেঘাটা দেশবন্ধু স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অকৃতকার্য হন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিশ্বব্যাপী ধ্বংস ও মৃত্যুর তাণ্ডবলীলা কিশোর সুকান্তকে দারুণভাবে স্পর্শ করে। এছাড়া সামাজিক নানা অনাচার ও বৈষম্য তাঁকে প্রবলভাবে আলোড়িত করে। তাঁর কবিতায় এই অনাচার ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে ধ্বনিত প্রবল প্রতিবাদ আমাদের সচকিত করে। নিপীড়িত গণমানুষের প্রতি গভীর মমতার প্রকাশ ঘটেছে তাঁর কবিতায়। তাঁর কাব্য : ছাড়পত্র, ঘুম নেই, পূর্বাভাস, অভিযান, হরতাল ইত্যাদি। ২৯শে বৈশাখ ১৩৫৪ বঙ্গাব্দে মাত্র একুশ বছর বয়সে কবি মৃত্যুবরণ করেন।]
রানার- ইংরেজি শব্দ ‘runner'-এর আভিধানিক অর্থ যিনি দৌড়ান । এখানে 'ডাক হরকরা' অর্থে ব্যবহৃত ।
নতুন খবর আনার— ডাক হরকরার ব্যাগে মানুষের সুখ-দুঃখের অনেক অজানা সংবাদ থাকে। চিঠি বিলি হলে সে সংবাদ মানুষ জানতে পারে। তাই ডাক হরকরাকে নতুন খবরের বাহক বলা হয়েছে।
দুর্বার- যাকে নিবারণ করা যায় না। হরিণের মতো যায়— এটি একটি উপমা হরিণ যেমন নিঃশব্দে কিন্তু অতি দ্রুত দৌড়ায়, রানারও তেমনি। লণ্ঠন— হারিকেন বা তেল দিয়ে চালিত আলোর আধার।
ভোর তো হয়েছে— আকাশ হয়েছে লাল— এটি প্রতীক। বাচ্যার্থে রাত্রির অন্ধকার শেষ হয়ে আকাশে সূর্য উঠছে। কিন্তু প্রতীকী অর্থে কষ্টের কালিমা দূরীভূত হয়ে সুখের সোনালি আলো দেখা দিচ্ছে।
পাঠ-পরিচিতি : সুকান্ত ভট্টাচার্যের 'রানার' কবিতাটি কবির ছাড়পত্র কাব্য থেকে সংকলন করা হয়েছে। কবিতাটি শ্রমজীবী মানুষ রানারদের নিয়ে লেখা। তাদের কাজ হচ্ছে গ্রাহকদের কাছে ব্যক্তিগত ও প্রয়োজনের চিঠি পৌঁছে দেওয়া। রানাররা এতটাই দায়িত্বশীল যে কোনো কিছুই তাদের কাজের বাধা হয়ে ওঠে না। রাত হোক, দুর্গম পথ হোক, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া হোক নিরন্তর তাদের এই কাজ করে যেতে হয়। চিঠি মানেই সুখে-আনন্দে, দুঃখে-শোকে ভরা সংবাদ। এই সংবাদের জন্যেই অপেক্ষায় থাকে প্রিয়জনরা। প্রিয়জনদের কাছে যথাসময়ে এই খবর পৌঁছে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। রানারদের তাই ক্লান্তি নেই, অবসর নেওয়ার অবকাশ নেই। তারা ছুটছেন তো ছুটছেনই। এই মহান পেশায় যারা নিয়োজিত রয়েছেন তারা যে মানুষ হিসেবে কতটা মহৎ, কবিতাটিতে এই ভাবনারই প্রতিফলন লক্ষ করা যায়।
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা
তোমাকে পাওয়ার জন্যে
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন ?
তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,
সাকিনা বিবির কপাল ভাঙল,
সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর।
তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মতো চিৎকার করতে করতে
তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস, বস্তি উজাড় হলো । রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটাল যত্রতত্র।
তুমি আসবে বলে ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম ।
তুমি আসবে বলে বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভুর বাস্তুভিটার
ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে একটানা আর্তনাদ করল একটা কুকুর ।
তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিল পিতা-মাতার লাশের উপর ।
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা, তোমাকে পাওয়ার জন্যে
তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা
আর কতবার ভাসতে হবে রক্তগঙ্গায়?
আর কতবার দেখতে হবে খাণ্ডবদাহন?
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে থুথুড়ে এক বুড়ো
উদাস দাওয়ায় বসে আছেন – তাঁর চোখের নিচে অপরাহ্ণের
দুর্বল আলোর ঝিলিক, বাতাসে নড়ছে চুল ।
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
মোল্লাবাড়ির এক বিধবা দাঁড়িয়ে আছে
নড়বড়ে খুঁটি ধরে দগ্ধ ঘরের।
স্বাধীনতা, তোমার জন্যে
হাড্ডিসার এক অনাথ কিশোরী শূন্য থালা হাতে
বসে আছে পথের ধারে ।
তোমার জন্যে,
সগীর আলী, শাহবাজপুরের সেই জোয়ান কৃষক,
কেষ্ট দাস, জেলেপাড়ার সবচেয়ে সাহসী লোকটা,
মতলব মিয়া, মেঘনা নদীর দক্ষ মাঝি,
গাজী গাজী বলে যে নৌকা চালায় উদ্দাম ঝড়ে,
রুস্তম শেখ, ঢাকার রিকশাওয়ালা, যার ফুসফুস
এখন পোকার দখলে
আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুরে-বেড়ানো
সেই তেজি তরুণ যার পদভারে
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে –
সেই তেজি তরুণ যার পদভারে
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।
পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত
ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে,
নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগ্বিদিক
এই বাংলায় তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা।
(সংক্ষেপিত)
শামসুর রাহমান ১৯২৯ সালের ২৪শে অক্টোবর ঢাকা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার পাড়াতলী গ্রাম। তাঁর পিতা মোখলেসুর রহমান চৌধুরী ও মাতা আমেনা খাতুন। তিনি ১৯৪৫ সালে ঢাকার পোগোজ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর পেশা ছিল সাংবাদিকতা। তিনি একনিষ্ঠভাবে কাব্য সাধনায় নিয়োজিত ছিলেন। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের প্রত্যাশা, হতাশা, বিচ্ছিন্নতা, বৈরাগ্য ও সংগ্রাম তাঁর কবিতায় সার্থকভাবে বিধৃত। তাঁর কবিতায় অতি আধুনিক কাব্যধারার বৈশিষ্ট্য সার্থকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। উপমা ও চিত্রকল্পে তিনি প্রকৃতিনির্ভর এবং বিষয় ও উপাদানে শহরকেন্দ্রিক। তাঁর প্রধান কাব্য : প্ৰথম গান দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে, রৌদ্র করোটিতে, বিধ্বস্ত নীলিমা, নিরালোকে দিব্যরথ, নিজ বাসভূমে, বন্দী শিবির থেকে, দুঃসময়ের মুখোমুখি, ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাঁটা, এক ধরনের অহংকার, আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি, আমি অনাহারী, বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে, দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে, বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়, গৃহযুদ্ধের আগে, হৃদয়ে আমার পৃথিবীর আলো, হরিণের হাড়, মানব হৃদয়ে নৈবেদ্য সাজাই ইত্যাদি। এছাড়া তাঁর কিছু অনুবাদ-কবিতা ও শিশুতোষ কবিতা রয়েছে। শামসুর রাহমান তাঁর অনন্যসাধারণ কবি-কীর্তির জন্য বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন। তিনি ১৭ই আগস্ট, ২০০৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
খাণ্ডবদাহন – খাণ্ডব মূলত মহাভারতের একটি বিখ্যাত অরণ্য, যা আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। নির্বিচারে ধ্বংস করা হয়েছিল অরণ্যের প্রায় সকল প্রাণিকে । এ কবিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনির হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞকে খাণ্ডবদাহন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সিঁথির সিঁদুর মুছে গেল হরিদাসীর – মুক্তিযুদ্ধের শহিদ হয়েছেন হরিদাসীর স্বামী। এ কারণে বিধবা হরিদাসীর সিঁথি থেকে সিঁদুর - মুছে ফেলতে হয়েছে । সনাতন ধর্মের বিবাহকেন্দ্রিক সংস্কৃতিতে সধবারা সিঁদুর পরেন, স্বামীর মৃত্যু হলে সিঁদুর মুছে ফেলতে হয়। হরিদাসীকেও হতে হয়েছে সিঁদুরবিহীন। যত্রতত্র – যেখানে সেখানে, সব জায়গায়, তুমি আসবে বলে...ছাত্রাবাস, বস্তি উজাড় হলো – নয় মাসব্যাপী সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদান বাহিনি নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়েছে। ধ্বংস করেছে ছাত্রাবাস, বস্তি। কারণ ছাত্রজনতার প্রবল প্রতিবাদ আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল ছাত্রাবাস ও বস্তি । হানাদার বাহিনি ও তাদের দোসররা চেয়েছিল প্রতিরোধের সংগ্রামকে স্তব্ধ করে দিতে। তাই তারা পুড়িয়ে দিয়েছিল গ্রাম ও শহর। নারকীয় এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল বাঙালি জাতিকে । প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে অপরিসীম আত্মত্যাগের মাধ্যমে। থুথুড়ে এক বুড়ো - বয়সের ভারে বিধ্বস্ত লোক, যার বয়স অনেক হয়েছে এবং চলাচল করতে যার কষ্ট হয়; রুস্তম শেখ এখন পোকার দখলে – রুস্তম শেখ নামের এক রিকশাওয়ালা, যিনি যুদ্ধে শহিদ হয়েছেন। মৃত অবস্থা বোঝানোর জন্য বলা হয়েছে ‘যার ফুসফুস এখন পোকার দখলে'।
‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা' শীর্ষক কবিতাটি শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা নামক কাব্য থেকে নেওয়া হয়েছে। কবিতাটি কবির বন্দী শিবির থেকে নামক কাব্যের অন্তর্ভুক্ত। স্বাধীনতা শুধু শব্দমাত্র নয়, এটি এমন এক অধিকার ও অনুভব যা মানুষের জন্মগত। কিন্তু এই অধিকার আদায়ের জন্য বাঙালি জাতিকে দীর্ঘ কাল যেমন সংগ্রাম করতে হয়েছে তেমনি করতে হয়েছে অপরিসীম আত্মত্যাগ । ১৯৭১ সালে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামে আপামর বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যুদ্ধচলাকালে বাঙালির রক্তে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয় পাকিস্তানি যুদ্ধবাজরা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে সকিনা বিবির মতো গ্রামীণ নারীর সহায়-সম্বল-সম্ভ্রম বিসর্জিত হয়েছে, হরিদাসী হয়েছে স্বামীহারা, নবজাতক হারিয়েছে মা-বাবাকে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালিদের ছাত্রাবাস আক্রমণ করে ছাত্রদের হত্যা করে, শহরের বুকে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে গণহত্যা চালায়, পুড়িয়ে দেয় গ্রাম ও শহরের লোকালয়। এর প্রাকৃতিক প্রতিবাদ ওঠে পশুর কণ্ঠেও। আর্তনাদ করে কুকুরও। মুক্তিযুদ্ধে শ্রমিক, কৃষক, জেলে, রিক্শাওয়ালা প্রমুখ সাধারণ মানুষ আত্মত্যাগ করে । দগ্ধ হওয়া লোকালয় প্রবীণ বাঙালির আলোকিত চোখে অগ্নি ঝরায় । সেইসঙ্গে নবীন রক্তে প্রাণস্পন্দন ও আশা জেগে থাকতে দেখে কবি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করেন— এত আত্মত্যাগ যার উদ্দেশ্যে সেই স্বাধীনতাকে বাঙালি একদিন ছিনিয়ে আনবেই। কবিতাটি মুক্তিযুদ্ধের অনবদ্য সাহিত্যিক দলিল ।
কিশোর তোমার দুই
রক্তভীষণ মুখমণ্ডলে চমকায় বরাভয় ৷
বুকের অধীর ফিনকির ক্ষুরধার
শহিদের খুন লেগে
কিশোর তোমার দুই হাতে
দুই সূর্য উঠেছে জেগে।
মানুষের হাতে অবাক সূর্যোদয়,
যায় পুড়ে যায় মর্তের অমানিশা
শঙ্কার সংশয়।
কিশোর তোমার হাত দুটো উঁচু রাখো
প্রবল অহংকারে সূর্যের সাথে
অভিন্ন দেখ অমিত অযুত লাখ ।
সারা শহরের মুখ
তোমার হাতের দিকে
ভয়হারা কোটি অপলক চোখ একাকার হলো
সূর্যের অনিমিখে।
কিশোর তোমার হাত দুটো উঁচু রাখো
লোলিত পাপের আমূল রসনা ক্রূর অগ্নিতে ঢাক।
রক্তের খরতানে
জাগাও পাবক প্রাণ
কণ্ঠে ফোটাও নিষ্ঠুরতম গান
যাক পুড়ে যাক আপামর পশু
মনুষ্যত্বের ধিক অপমান
কিশোর তোমার হাত দুটো উঁচু রাখো
কুহেলী পোড়ানো মিছিলের হুতাশনে
লাখ অযুতকে ডাক।
কিশোর তোমার দুই
হাতের তালুতে আকুল সূর্যোদয়
রক্তশোভিত মুখমণ্ডলে চমকায় বরাভয়।
হাসান হাফিজুর রহমান ১৪ই জুন ১৯৩২ সালে জামালপুর জেলার কুলকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আবদুর রহমান ছিলেন স্কুলশিক্ষক। হাসান হাফিজুর রহমান ১৯৪৬ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৪৮ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আই.এ. পাস করেন। ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. এ. এবং ১৯৫৫ সালে বাংলায় এম. এ. ডিগ্রি লাভ করেন । তিনি ছিলেন ভাষা- আন্দোলনের একজন অসাধারণ সংগঠক। ১৯৫৩ সালে তাঁর সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারি গ্রন্থটি বিস্ময়কর আলোড়ন সৃষ্টি করে । কর্মজীবনে তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় সাংবাদিকতাসহ অধ্যাপনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি ছিলেন অকুতোভয় এক সৈনিক। স্বাধীনতা-উত্তর কালে তিনি সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭৭ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রকল্প'-এর তিনি ছিলেন প্রধান। তাঁর সম্পাদনায় ষোলো খণ্ডে ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ : দলিলপত্র' প্রকাশিত হয়। তিনি কবি, সমালোচক ও গল্পকার হিসেবে খ্যাতিমান। বিভাগ উত্তর পূর্ববাংলার আধুনিক কাব্য আন্দোলনের তিনি ছিলেন একজন অন্যতম স্থপতি। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্য : বিমুখ প্রান্তর, আর্ত-শব্দাবলি, অন্তিম শরের মতো, উদ্যত সঙ্গীন, শোকার্ত তরবারি, আমার ভেতরের বাঘ ইত্যাদি । প্রবন্ধগ্রন্থ : আধুনিক কবি ও কবিতা, সাহিত্য প্রসঙ্গ, গল্পগ্রন্থ : আরো দুটি মৃত্যু ইত্যাদি। হাসান হাফিজুর রহমান লেখক সংঘ পুরস্কার, আদমজী পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন। ১৯৮৩ সালের ১লা এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন ।
আকুল সূর্যোদয় – নতুন দিন আসার ব্যগ্র বাসনা। বরাভয়- আশীর্বাদ বা আশ্বাসসূচক করভঙ্গি বা হাতের মুদ্রাবিশেষ। খুন - রক্ত। মর্ত্যের অমানিশা- পৃথিবীর দুর্দিন বা পৃথিবীর অন্ধকার। অমিত- অপরাজেয়। অযুত- দশ হাজার, অপলক – পলকহীন। অনিমিখে - এক দৃষ্টিতে পলকহীনভাবে। লোলিত - কম্পিত, আন্দোলিত। খরতানে – কর্কশ সুরে। পাবক- আগুন। আপামর – সর্বসাধারণ। কুহেলী – কুয়াশা। রক্তশোভিত – রক্ত দ্বারা রঞ্জিত। -
কিশোর বয়সটি হচ্ছে দুর্জয় সাহস আর সৃষ্টিশীলতার সময়। কবিতাটি এই কিশোর বন্দনারই গাথা। চমৎকার কিছু ছবি, ভাবনা আর প্রতীকের মধ্য দিয়ে কবি এখানে কিশোরদের জয়গান করেছেন। কবি মনে করেন, কিশোররাই হচ্ছে সেই ভয়হীন সত্তার অধিকারী, শহিদের খুন যাদের দুই হাতে সূর্যোদয় হয়ে জেগে ওঠে। এই সূর্যের আলোতেই কেটে যায় পৃথিবীর অন্ধকার। কিশোর তার দুই হাতকে সূর্যের মতোই অহংকারে উঁচু করে রাখুক, এটাই কবির কামনা। উত্তোলিত এই হাতই, কবি মনে করেন, মানুষকে বরাভয় হতে শেখাবে। ঢেকে যাবে সমস্ত পাপ। পুড়ে যাবে পশুত্ব। অযুত মানুষকে মিছিলে জানাবে আহ্বান। সূর্য আর উত্তোলিত হাতের প্রতীকে কৈশোরক সাহসিকতা আর বরাভয়কে এভাবেই বর্ণনা করেছেন কবি ।
আমি জন্মেছি বাংলায়, আমি বাংলায় কথা বলি,
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে হাজার বছর চলি।
চলি পলিমাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
তেরোশত নদী শুধায় আমাকে, ‘কোথা থেকে তুমি এলে?”
আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে ।
আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে। ।
আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে।
আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে ।
এসেছি বাঙালি বরেন্দ্রভূমে সোনা মসজিদ থেকে ।
এসেছি বাঙালি আউল-বাউল মাটির দেউল থেকে।
আমি তো এসেছি সার্বভৌম বারোভূঁইয়ার থেকে ।
এসেছি বাঙালি পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার থেকে ।
এসেছি বাঙালি জোড়বাংলার মন্দির-বেদি থেকে ।
আমি তো এসেছি 'কমলার দীঘি’, ‘মহুয়ার পালা' থেকে।
আমি তো এসেছি তিতুমীর আর হাজী শরিয়ত থেকে।
আমি তো এসেছি গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীণার থেকে ।
এসেছি বাঙালি ক্ষুদিরাম আর সূর্য সেনের থেকে ।
এসেছি বাঙালি জয়নুল আর অবন ঠাকুর থেকে ।
এসেছি বাঙালি রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ থেকে ।
এসেছি বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর থেকে।
আমি যে এসেছি জয়বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে ।
আমি যে এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে।
এসেছি আমার পেছনে হাজার চরণচিহ্ন ফেলে।
শুধাও আমাকে ‘এতদূর তুমি কোন প্রেরণায় এলে?”
তবে তুমি বুঝি বাঙালি জাতির বীজমন্ত্রটি শোন নাই –
‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।'
একসাথে আছি, একসাথে বাঁচি, আজও একসাথে থাকবই –
সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবই ।
সৈয়দ শামসুল হক ২৭শে ডিসেম্বর ১৯৩৫ সালে কুড়িগ্রাম শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ডা. সৈয়দ সিদ্দিক হুসাইন এবং মাতার নাম সৈয়দা হালিমা খাতুন। তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, জগন্নাথ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে কিছুদিন পড়াশোনা করেন। একসময় পেশায় সাংবাদিকতাকে বেছে নিলেও পরবর্তী সময়ে তিনি সার্বক্ষণিক সাহিত্যকর্মে নিমগ্ন থেকে বৈচিত্র্যময় সম্ভারে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও নাটক রচনা করেছেন। তাঁর শিশুতোষ রচনাও রয়েছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অনেক সাহিত্য-পুরস্কার লাভ করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্য: একদা এক রাজ্যে, বৈশাখে রচিত পঙক্তিমালা, অগ্নি ও জলের কবিতা, রাজনৈতিক কবিতা; গল্পগ্রন্থ: শীত বিকেল, রক্তগোলাপ, আনন্দের মৃত্যু, জলেশ্বরীর গল্পগুলো; উপন্যাস: বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ; নাটক : পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়, নূরলদীনের সারাজীবন, ঈর্ষা; শিশুতোষ গ্রন্থ : সীমান্তের সিংহাসন। ২৭শে সেপ্টেম্বর ২০১৬ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন
আলপথ – জমির সীমানার পথ। এখানে হাজার বছর ধরে বাঙালি জাতির পথ চলার কথা - বলা হয়েছে; চর্যাপদ - বাংলা ভাষা ও সাহিত্য-ঐতিহ্যের প্রথম নিদর্শন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল থেকে চর্যাপদের পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করেন। ছয়শ' শতক থেকে এগারশ' শতকের মধ্যে পদগুলো রচিত হয়েছে। এই পদগুলোর মধ্যে প্রাচীন বাংলার অতি সাধারণ মানুষের প্রাণময় জীবন চিত্র ফুটে উঠেছে। সওদাগরের ডিঙার বহর – মঙ্গলকাব্যে চাঁদ সওদাগরের বাণিজ্যের কথা আছে। কবি আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ঐতিহ্য বোঝাতে এই লোককাহিনীর আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। কৈবর্ত বিদ্রোহ - একাদশ শতক থেকে আনুমানিক (১০৭০-১০৭৭ খ্রিষ্টাব্দে) মহীপালের বিরুদ্ধে অনন্ত-সামন্ত-চক্র মিলিত হয়ে যে বিদ্রোহ করেন তা-ই আমাদের ইতিহাসে কৈবর্ত বিদ্রোহ নামে খ্যাত। এই বিদ্রোহের নেতা ছিলেন কৈবর্ত সম্প্রদায়ের লোক। তাঁর নাম দিব্য বা দিৱোক। বাঙালি জাতির বিদ্রোহের ঐতিহ্য বোঝাতে এই বিদ্রোহের উল্লেখ করা হয়েছে। পালযুগ – ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে গোপালের রাজ্য শাসনের মধ্য দিয়ে বঙ্গে পালযুগের সূচনা হয়। তারপর চারশত বছর পাল বংশের রাজত্ব টিকে ছিল। এ সময় শিল্প-সাহিত্যের অসামান্য বিকাশ সাধিত হয়। চিত্রকলায়ও এই সময়ের সমৃদ্ধি লক্ষযোগ্য। কবি আমাদের শিল্পের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য বোঝাতে পালযুগের চিত্রকলার উল্লেখ করেছেন। পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার - বর্তমান নওগাঁ জেলার বদলগাছি থানায় পাহাড়পুর গ্রামে এই প্রাচীন বিহার অবস্থিত। ১৮৭৯ সালে স্যার কানিংহাম এই বিশাল কীর্তি আবিষ্কার করেন। দ্বিতীয় পাল রাজা শ্রী ধর্মপালদেব (রাজত্বকাল ৭৭৭-৮১০ খ্রি.) এই বিশাল বিহার তৈরি করেছিলেন। একে সোমপুর বিহারও বলা হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিহারগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। কবি আমাদের প্রত্নতাত্ত্ব ঐতিহ্যের পরিচয় দিতে পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহারের উল্লেখ করেছেন। বরেন্দ্রভূমে সোনামসজিদ – বরেন্দ্রভূমে সোনামসজিদ বলতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় অবস্থিত ছোট সোনামসজিদকে বোঝানো হয়েছে। বড় সোনামসজিদ ভারতের গৌড়ে অবস্থিত। হোসেন শাহের (রাজত্বকাল ১৪৯৩-১৫১৯ খ্রি.) আমলে এই মসজিদটি নির্মিত হয় । অসাধারণ শিল্পসৌন্দর্যমণ্ডিত স্থাপত্যকর্ম হিসেবে সোনামসজিদ অন্যতম। কবি আমাদের মুসলিম ঐতিহ্যের সুমহান নিদর্শন দিয়ে এটি উল্লেখ করেছেন; দেউল – দেবালয়; সার্বভৌম বারোভূঁইয়া – বাংলায় পাঠান কররানী বংশের রাজত্ব দুর্বল হয়ে পড়লে খুলনা, বরিশাল, সোনারগাঁও, ময়মনসিংহ ও শ্রীহট্টে স্বাধীন জমিদারদের উত্থান ঘটে। ১৫৭৫ সালে মোগল সম্রাট আকবর বাংলা জয় করার পর এই স্বাধীন জমিদারগণ ঈসা খাঁর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মোগল শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। ইতিহাসে এঁরাই বারোভূঁইয়া নামে পরিচিত। এঁরা হলেন ঈশা খাঁ, চাঁদ রায়, কেদার রায়, প্রতাপাদিত্য, লক্ষ্মণ মাণিক্য প্রমুখ; কমলার দীঘি – মৈমনসিংহ গীতিকার একটি পালা; মহুয়ার পালা মৈমনসিংহ গীতিকার একটি পালা; তিতুমীর - চব্বিশ পরগনা জেলার হায়দরপুর গ্রামে ১৭৮২ সালে মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অত্যাচারী ইংরেজ ও হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন সংগ্রাম করেছেন। ১৮৩১ সালের ১৯শে নভেম্বর ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে তিনি শহিদ হন। হাজী শরীয়ত – হাজী শরীয়তউল্লাহ (১৭৮১-১৮৪০ খ্রি.) মাদারীপুর জেলার শিবচর থানার সামাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি দীর্ঘকাল মক্কায় অবস্থান করে ইসলাম ধর্ম বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। তিনি ধর্মকে আশ্রয় করে সকল কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তাঁর এই আন্দোলনকে ফরায়েজি আন্দোলন বলে। এরপর তিনি আবদুল ওহাব নামক এক ধর্মসংস্কারকের মতাদর্শে বিশ্বাসী হয়ে ওহাবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন । তিনি সাধারণ মানুষকে ধর্মের প্রকৃত রূপ ও তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা করেছেন। এছাড়া বিদেশি শাসন-শোষণ; জমিদার, জোতদার ও মহাজনদের অত্যাচার থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্য আন্দোলন করেন। ক্ষুদিরাম – ক্ষুদিরাম বসু (১৮৮৯-১৯০৮ খ্রি.) মেদিনীপুর জেলার মৌবনি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত বাংলা সাহিত্য
ছিলেন। অত্যাচারী ম্যাজিস্ট্রেট কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে গিয়ে ভুলবশত দুইজন ইংরেজ নারীকে হত্যা করেন। ১৯০৮ সালের ১১ই আগস্ট এই মহান বিপ্লবীর ফাঁসির আদেশ কার্যকর হয়। সূর্য সেন- মাস্টার দা সূর্য সেন (১৮৯৩-১৯৩৪ খ্রি.) চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার নোয়াপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। আজীবন তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৩০ সালে তিনি চট্টগ্রামকে ইংরেজমুক্ত করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। কিন্তু বেশিদিন তা রক্ষা করতে পারেন নি। ১৯৩৪ সালের ১২ই জানুয়ারি তাঁর ফাঁসি হয়। জয়নুল— জয়নুল আবেদিন (১৯১৪-১৯৭৬ খ্রি.) কিশোরগঞ্জের কেন্দুয়া থানায় জন্মগ্রহণ করেন । ‘শিল্পাচার্য’ হিসেবে তিনি খ্যাত। দেশজ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পটভূমিতে তাঁর বিপুল শিল্পকর্ম রচিত। দুর্ভিক্ষতাড়িত জীবন ও জগতের ছবি এঁকে তিনি অসামান্য এক জীবন-তৃষ্ণার পরিচয় দিয়েছেন। বাংলাদেশে শিল্পকলা আন্দোলনের তিনি পথিকৃৎ। অবন্ ঠাকুর - অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১-১৯৫১ খ্রি.) কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিখ্যাত চিত্রশিল্পী। তবে শিশুসাহিত্যিক হিসেবেও তিনি অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ -১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার অধিকারের জন্য এদেশের মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে ঢাকার রাজপথ। আর সেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সাফল্যের পথ ধরেই সূচিত হয় স্বাধীনতা আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর — বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫ খ্রি.)। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে তিনি অভিষিক্ত। তিনি ফরিদপুর জেলার (বর্তমান গোপালগঞ্জ) টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাঙালি জাতির তিনি অবিসংবাদিত নেতা, জাতির পিতা। তাঁর বিস্ময়কর প্রতিভাদীপ্ত নেতৃত্বে দীর্ঘ সংগ্রামের পথ অতিক্রম করে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতাযুদ্ধে জয়লাভ করে । তিনি আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক, মুক্তির প্রতীক, সমৃদ্ধির প্রতীক। জয় বাংলা – মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জাতীয় স্লোগান হিসেবে অসাধারণ এক প্রেরণা সঞ্চারী শব্দমালা। এই স্লোগান ঐক্য ও সংহতির প্রতীক। ২০২০ সালের ১০ই মার্চ ‘জয় বাংলা' স্লোগানকে বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হিসেবে গ্রহণের জন্য হাইকোর্ট রায় প্রদান করে ৷
সৈয়দ শামসুল হকের কিশোর কবিতা সমগ্র থেকে ‘আমার পরিচয়' শীর্ষক কবিতাটি সম্পাদিত আকারে চয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন-সার্বভৌম একটি দেশ। আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন এই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র ও জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার পশ্চাতে আছে সমৃদ্ধ এক ইতিহাস। সৈয়দ শামসুল হক গভীর মমত্বের সঙ্গে কবিতার আঙ্গিকে চিত্রিত করেছেন সমৃদ্ধ সেই ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পটভূমি। সহজিয়াপন্থী বৌদ্ধ কবিদের সৃষ্ট চর্যাপদের মধ্যে বাঙালি জাতিসত্তার যে অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধের পরিচয় মুদ্রিত হয়ে আছে – যুগে যুগে নানা আন্দোলন, বিপ্লব-বিদ্রোহ, আর মতাদর্শের বিকাশ হতে হতে আমরা এসে পৌঁছেছি আজকের বাংলায়। সৈয়দ শামসুল হক এই বিবর্তনের বিচিত্র বাঁক ও মোড় তাৎপর্যময় করে তুলেছেন। চাঁদ-সওদাগরের বাণিজ্য যাত্রা, কৈবর্তবিদ্রোহ, পালযুগের চিত্রকলা আন্দোলন, বৌদ্ধবিহারের জ্ঞানচর্চা, মুসলিম ধর্ম ও সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশ, বারোভূঁইয়াদের উত্থান, ময়মনসিংহ গীতিকার জীবন, তিতুমীর আর হাজী শরীয়তের বিদ্রোহ, রবীন্দ্র-নজরুলের কালজয়ী সৃষ্টি, ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং পরিশেষে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীন বাংলাদেশ ‘আমার পরিচয়' কবিতার মধ্যে এই বিপুল বাংলাদেশ অনবদ্যরূপ লাভ করেছে।
যে বাতাসে বুনোহাঁসের ঝাঁক ভেঙে যায়
জেটের পাখা দুমড়ে শেষে আছাড় মারে
নদীর পানি শূন্যে তুলে দেয় ছড়িয়ে
নুইয়ে দেয় টেলিগ্রাফের থামগুলোকে।
সেই পবনের কাছে আমার এই মিনতি
তিষ্ঠ হাওয়া, তিষ্ঠ মহাপ্রতাপশালী,
গরিব মাঝির পালের দড়ি ছিঁড়ে কী লাভ?
কী সুখ বলো গুঁড়িয়ে দিয়ে চাষির ভিটে?
বেগুন পাতার বাসা ছিঁড়ে টুনটুনিদের
উল্টে ফেলে দুঃখী মায়ের ভাতের হাঁড়ি
হে দেবতা, বলো তোমার কী আনন্দ,
কী মজা পাও বাবুই পাখির ঘর উড়িয়ে?
রামায়ণে পড়েছি যার কীর্তিগাথা
সেই মহাবীর হনুমানের পিতা তুমি ?
কালিদাসের মেঘদূতে যার কথা আছে
তুমিই নাকি সেই দয়ালু মেঘের সাথী ?
তবে এমন নিঠুর কেন হলে বাতাস
উড়িয়ে নিলে গরিব চাষির ঘরের খুঁটি
কিন্তু যারা লোক ঠকিয়ে প্রাসাদ গড়ে
তাদের কোনো ইট খসাতে পারলে নাতো।
হায়রে কতো সুবিচারের গল্প শুনি,
তুমিই নাকি বাহন রাজা সোলেমানের
যার তলোয়ার অত্যাচারীর কাটতো মাথা
অহমিকার অট্টালিকা গুঁড়িয়ে দিতো।
কবিদের এক মহান রাজা রবীন্দ্রনাথ
তোমার কাছে দাঁড়িয়েছিলেন করজোড়ে
যা পুরানো শুষ্ক মরা, অদরকারি
কালবোশেখের একটি ফুঁয়ে উড়িয়ে দিতে।
ধ্বংস যদি করবে তবে, শোনো তুফান
ধ্বংস করো বিভেদকারী পরগাছাদের
পরের শ্রমে গড়ছে যারা মস্ত দালান
বাড়তি তাদের বাহাদুরি গুঁড়িয়ে ফেলো।
আল মাহমুদ ১৯৩৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। তিনি দীর্ঘকাল সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরে তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে যোগদান করেন এবং পরিচালকের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন । মুক্তিযুদ্ধ তাঁকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। স্বাধীনতার পর তিনি ‘দৈনিক গণকণ্ঠ' পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত হন। তাঁর কবিতায় লোকজ শব্দের সুনিপুণ প্রয়োগ যেমন লক্ষণীয় তেমনি রয়েছে ঐতিহ্যপ্রীতি। তাঁর প্রকাশিত কাব্য : লোক লোকান্তর, কালের কলস, সোনালী কাবিন, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো, আরব্য রজনীর রাজহাঁস, বখতিয়ারের ঘোড়া ইত্যাদি। কথাসাহিত্য : পানকৌড়ির রক্ত, পাখির কাছে ফুলের কাছে তাঁর শিশুতোষ কবিতার বই। কবি ২০১৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন ।
বুনোহাঁস - যে হাঁস গৃহপালিত নয়, বনে থাকে। জেট— দ্রুতগতিসম্পন্ন উড়োজাহাজ। টেলিগ্রাফ- সংকেতের সাহায্যে দূরে বক্তব্য প্রেরণের জন্য ব্যবহৃত যন্ত্র। ১৮৩৭ সালে আধুনিক এই যন্ত্র বিদ্যুতের সাহায্যে পরিচালিত হয়। (এখন এ ধরনের যন্ত্র আর ব্যবহার হয় না।)। তিষ্ঠ— স্থির হও। রামায়ণ— পৃথিবীর চারটি জাত মহাকাব্যের একটি। রচয়িতা- বাল্মীকি। মহাবীর হনুমান— রামায়ণে বীর হনুমানের বীরত্বপূর্ণ বহু কর্মের কথা উল্লেখ আছে। রামায়ণোক্ত হনুমানকে মহাবীর হনুমান বলা হয়। কালিদাসের মেঘদূত- সংস্কৃত ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন কালিদাস। সংস্কৃত ভাষায় তাঁর অমর রচনা মেঘদূতম্ কাব্য। মেঘদূতকে বাংলায় মেঘদূত বলা হয়। রাজা সোলেমান— ডেভিডের পুত্র এবং ইসরাইলের তৃতীয় রাজা। তিনি বীর ও দক্ষ যোদ্ধা ছিলেন । রবীন্দ্রনাথ— বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি। অদরকারি- যার প্রয়োজন নেই ।
কবি আল মাহমুদের কবিতা সমগ্রের পাখির কাছে ফুলের কাছে কাব্য থেকে ‘বোশেখ’ কবিতাটি সংকলন করা হয়েছে। বাংলাদেশের একটি পরাক্রমশালী মাস বৈশাখ । ঋতু পরিক্রমায় বার বার সে রুদ্র সংহারক রূপে আবির্ভূত হয়। বৈশাখের নিষ্ঠুর করাল গ্রাসে এবং আগ্রাসী থাবায় কখনও কখনও লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় এক-একটা জনপদ । অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর শিকার হয় দুঃখী দরিদ্র মানুষ বা অসহায় কোন প্রাণী। ছিঁড়ে যায় গরিব মাঝির পালের দড়ি, উড়ে যায় দরিদ্র চাষির ঘর। ছোট্ট টুনটুনির বাসাও রেহাই পায় না। কিন্তু ধনীর প্রাসাদের কোন ক্ষতি হয় না। কবি তাই আক্ষেপ করে বলছেন, প্রকৃতির যত নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা কেন তা শুধু এই গরিবের বিরুদ্ধেই ঘটবে? অবশেষে বৈশাখের কাছে তার আহ্বান, ধ্বংস যদি করতেই হয়, তাহলে গুঁড়িয়ে দাও সেইসব অট্টালিকা যা গড়ে উঠেছে শ্রমজীবী সাধারণ মানুষকে শোষণ করে। এই কবিতায় বৈশাখের বিধ্বংসী প্রতীকের মধ্য দিয়ে অত্যাচারীর অবসান কামনা করছেন কবি ।
স্পর্শ কাতরতাময় এই নাম
উচ্চারণমাত্র যেন ভেঙে যাবে,
অন্তর্হিত হবে তার প্রকৃত মহিমা,
চুনিয়া একটি গ্রাম, ছোট্ট – কিন্তু ভেতরে-ভেতরে
খুব শক্তিশালী
মারণাস্ত্রময় সভ্যতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে ।
মধ্যরাতে চুনিয়া নীরব ।
চুনিয়া তো ভালোবাসে শান্তস্নিগ্ধ পূর্ণিমার চাঁদ,
চুনিয়া প্রকৃত বৌদ্ধ-স্বভাবের নিরিবিলি সবুজ প্রকৃতি;
চুনিয়া যোজনব্যাপী মনোরম আদিবাসী ভূমি ।
চুনিয়া কখনো কোনো হিংস্রতা দ্যাখেনি ।
চুনিয়া গুলির শব্দে আঁতকে ওঠে কি?
প্রতিটি গাছের পাতা মনুষ্যপশুর হিংস্রতা দেখে না না করে ওঠে?
- চুনিয়া মানুষ ভালোবাসে ।
বৃক্ষদের সাহচর্যে চুনিয়াবাসীরা প্রকৃত প্রস্তাবে খুব
সুখে আছে ।
চুনিয়া এখনো আছে এই সভ্যসমাজের
কারো কারো মনে,
কেউ-কেউ এখনো তো পোষে
বুকের নিভৃতে এক নিবিড় চুনিয়া ।
চুনিয়া শুশ্রূষা জানে,
চুনিয়া ব্যান্ডেজ বাঁধে, চুনিয়া সান্ত্বনা শুধু -
চুনিয়া কখনো জানি কারুকেই আঘাত করে না;
চুনিয়া সবুজ খুব, শান্তিপ্রিয় – শান্তি ভালোবাসে,
কাঠুরের প্রতি তাই স্পষ্টতই তীব্র ঘৃণা হানে ।
চুনিয়া চিৎকার খুব অপছন্দ করে,
চুনিয়া গুলির শব্দ পছন্দ করে না ।
রক্তপাত, সিংহাসন প্রভৃতি বিষয়ে
চুনিয়া ভীষণ অজ্ঞ;
চুনিয়া তো সর্বদাই মানুষের আবিষ্কৃত
মারণাস্ত্রগুলো
ভূমধ্যসাগরে ফেলে দিতে বলে ।
চুনিয়া তো চায় মানুষেরা তিনভাগ জলে
রক্তমাখা হাত ধুয়ে তার দীক্ষা নিক ।
চুনিয়া সর্বদা বলে পৃথিবীর কুরুক্ষেত্রগুলি
সুগন্ধি ফুলের চাষে ভরে তোলা হোক ।
চুনিয়ারও অভিমান আছে,
শিশু ও নারীর প্রতি চুনিয়ার পক্ষপাত আছে;
শিশুহত্যা, নারীহত্যা দেখে দেখে সে-ও
মানবিক সভ্যতার প্রতি খুব বিরূপ হয়েছে।
চুনিয়া নৈরাশ্যবাদী নয়, চুনিয়া তো মনেপ্রাণে
নিশিদিন আশার পিদিম জ্বেলে রাখে
চুনিয়া বিশ্বাস করে;
শেষাবধি মানুষেরা হিংসা-দ্বেষ ভুলে
পরস্পর সৎপ্রতিবেশী হবে।
(সংক্ষেপিত)
রফিক আজাদ ১৪ই ফেব্রুয়ারি ১৯৪১ সালে টাঙ্গাইল জেলার জাহিদগঞ্জের গুণীগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সালিম উদ্দিন খান এবং মাতা রাবেয়া খান। তিনি ১৯৫৯ সালে টাঙ্গাইলের ব্রাহ্মণশাসন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রবেশিকা এবং ১৯৬২ সালে নেত্রকোনা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৬ ও ১৯৬৭ সালে তিনি বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি সাংবাদিকতা, অধ্যাপনা ও সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন। প্রেম, দ্রোহ ও প্রকৃতিনির্ভর কবিতার এক তাৎপর্যপূর্ণ জগৎ তিনি সৃষ্টি করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্য: অসম্ভবের পায়ে, চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া, সশস্ত্র সুন্দর, হাতুড়ির নিচে জীবন, পরিকীর্ণ পানশালায় আমার স্বদেশ, অপর অরণ্যে, বিরিশিরি পর্ব ইত্যাদি। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি আলাওল পুরস্কার এবং বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন। ১২ই মার্চ ২০১৬ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
অন্তর্হিত - মিলিয়ে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া। মারণাস্ত্রময় ... দাঁড়াবে – স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতোই মনে প্রাণে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ও সার্বিকভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। চুনিয়া গ্রামটিও ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকা। তারা মুক্তিযুদ্ধে যেমন অসীম সাহসিকতার স্বাক্ষর রেখেছেন, তেমনি কবি মনে করছেন পৃথিবীর যেকোনো মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধেই তারা রুখে দাঁড়াবে। প্রকৃত বৌদ্ধ-স্বভাবের - মহামানব গৌতমবুদ্ধ মূলত অহিংস নীতিবাদী ছিলেন । এখানে যে সম্প্রদায়ের কথা বলা হয়েছে তারাও বৌদ্ধ- ধর্মাবলম্বী, এরা গৌতম বুদ্ধের মতোই শান্তিপ্রিয় ও অহিংস মনোভাবের মানুষ— এ বোধটিকে বোঝানো হয়েছে। যোজনব্যাপী – যোজন শব্দের অর্থ 'অনেক' বা বহু। এখানে শব্দটি স্থানবাচনার্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। যোজনব্যাপী হলো অনেকটা স্থানব্যাপী। আঁতকে – চমকে, হঠাৎ ভয় পেয়ে। সাহচর্য – একসঙ্গে মিলেমিশে। দীক্ষা – তত্ত্বজ্ঞান লাভ, এক ধরনের শপথ নেয়া। কুরুক্ষেত্র – প্রাচীন ভারতের একটি ঐতিহাসিক স্থান কুরুক্ষেত্র। যেখানে কৌরব এবং পাণ্ডবদের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। কাহিনীটি মহাভারতে বর্ণিত হয়েছে; নৈরাশ্যবাদী – নিরাশ ব্যক্তি, হতাশ ব্যক্তি, পিদিম – প্রদীপ, বাতি। আর্কেডিয়া- গ্রিসের একটি জায়গা, যা বহুকাল আগে থেকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং শান্তি প্রিয়তার জন্য বিখ্যাত ৷
‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া' কবিতাটি কবি রফিক আজাদের ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া' কাব্য থেকে সংকলিত হয়েছে। এটি একটি প্রতীকী গদ্য কবিতা। ‘চুনিয়া' নামের একটি গ্রামের প্রতীকের মধ্য দিয়ে কবি মানুষকে সুন্দরভাবে বাঁচার আহ্বান জানাচ্ছেন। কবির কথায়, চুনিয়া একটি ছোট্ট আদিবাসী গ্রাম । শহর থেকে অনেক দূরে এর অবস্থান। মনোরম সবুজ প্রকৃতির পটভূমিতে স্থাপিত বলে চুনিয়া কখনো হিংস্রতা দেখেনি। রক্তপাত দেখেনি। চুনিয়া শুধু জানে মানুষকে ভালোবাসতে । মানবসমাজে আজ যে হিংসা হানাহানি রক্তপাত দেখা যায়, চুনিয়াতে এসব নেই। সবাই এখানে তাই সুখে থাকে। কবি মনে করেন, প্রতিটি মানুষই আসলে এরকম। সভ্যসমাজের অনেকেই এই ধরনের স্নিগ্ধ সুন্দর গ্রামকে অথবা গ্রামের মতো পরিবেশকে বুকের মধ্যে লালন করে থাকেন। চুনিয়া বিশ্বাস করে, মানুষ মারণাস্ত্র ফেলে, হিংসা-দ্বেষ ভুলে পরস্পর সৎ প্রতিবেশী হবে। কেননা মানবতার পক্ষে দাঁড়ানোই হচ্ছে মানবসভ্যতার মূল কথা ।
একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য অপেক্ষার উত্তেজনা নিয়ে
লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে
ভোর থেকে জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে: 'কখন আসবে কবি?'
এই শিশু পার্ক সেদিন ছিল না,
এই বৃক্ষে ফুলে শোভিত উদ্যান সেদিন ছিল না,
এই তন্দ্রাচ্ছন্ন বিবর্ণ বিকেল সেদিন ছিল না ।
তাহলে কেমন ছিল সেদিনের সেই বিকেল বেলাটি?
তা হলে কেমন ছিল শিশু পার্কে, বেঞ্চে, বৃক্ষে, ফুলের বাগানে
ঢেকে দেয়া এই ঢাকার হৃদয় মাঠখানি ?
জানি, সেদিনের সব স্মৃতি মুছে দিতে হয়েছে উদ্যত
কালো হাত । তাই দেখি কবিহীন এই বিমুখ প্রান্তরে আজ
কবির বিরুদ্ধে কবি,
মাঠের বিরদ্ধে মাঠ,
বিকেলের বিরুদ্ধে বিকেল,
উদ্যানের বিরুদ্ধে উদ্যান,
মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ,
হে অনাগত শিশু, হে আগামী দিনের কবি,
শিশু পারকের রঙিন দোলনায় দল খেতে খেতে তুমি
একদিন সব জানতে পারবে; আমি তোমাদের কথা ভেবে
লিখে রেখে যাচ্ছি সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প।
সেদিন এই উদ্যানের রূপ ছিল ভিন্নতর।
না পার্ক না ফুলের বাগান,—এসবের কিছুই ছিল না,
শুধু একখণ্ড অখণ্ড আকাশ যেরকম, সেরকম দিগন্ত প্লাবিত
ধু ধু মাঠ ছিল দূর্বাদলে ঢাকা, সবুজে সবুজময়।
আমাদের স্বাধীনতা প্রিয় প্রাণের সবুজ এসে মিশেছিল
এই ধু ধু মাঠের সবুজে।
কপালে কব্জিতে লালসালু বেঁধে
এই মাঠে ছুটে এসেছিল কারখানা থেকে লোহার শ্রমিক,
লাঙল জোয়াল কাঁধে এসেছিল ঝাঁক বেঁধে উলঙ্গ কৃষক,
হাতের মুঠোয় মৃত্যু, চোখে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল মধ্যবিত্ত,
নিম্নবিত্ত, করুণ কেরানি, নারী, বৃদ্ধ, ভবঘুরে
আর তোমাদের মতো শিশু পাতা-কুড়ানিরা দল বেঁধে ।
একটি কবিতা পড়া হবে, তার জন্য কী ব্যাকুল
প্রতীক্ষা মানুষের : ‘কখন আসবে কবি?' ‘কখন আসবে কবি?’
শত বছরে শত সংগ্রাম শেষে,
রবীন্দ্রনাথের মতো দৃপ্ত পায়ে হেঁটে
অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন ।
তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল,
হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা । কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?
গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর কবিতাখানি :
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ।’
সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের ।
(সংক্ষেপিত)
নির্মলেন্দু গুণ ১৯৪৫ সালে নেত্রকোনা জেলার কাশবন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সুখেন্দু প্রকাশ গুণ চৌধুরী এবং মাতা বীণাপানি গুণ। নির্মলেন্দু গুণ ১৯৬২ সালে সিকেপি ইনস্টিটিউশন, বারহাট্টা থেকে মাধ্যমিক, ১৯৬৪ সালে নেত্রকোনা কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করেন। ষাটের দশকের সূচনা থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত তিনি কবিতায় ও গদ্যে স্বচ্ছন্দে সৃজনশীল হলেও কবি হিসেবেই তিনি খ্যাত। তাঁর কবিতায় প্রতিবাদী চেতনা, সমকালীন সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনের ছবি যেমন প্রখর, কবিতা-নির্মাণে শিল্প-সৌন্দর্যের প্রতিও তেমনি তিনি সজাগ। নির্মলেন্দু গুণ পেশায় সাংবাদিক। কাব্য সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, কবি হাসান হাফিজুর রহমান স্মৃতি স্বর্ণপদক, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্য: প্রেমাংশুর রক্ত চাই, বাংলার মাটি বাংলার জল, চাষাভূষার কাব্য, পঞ্চাশ সহস্ৰ বর্ষ; ছোটগল্প: আপন দলের মানুষ। ছোটদের জন্য লেখা উপন্যাস : কালোমেঘের ভেলা, বাবা যখন ছোট ছিলেন ।
উন্মত্ত - দারুণ উত্তেজনায় আবেগবিহ্বল, ক্ষিপ্ত। শোভিত – সজ্জিত, উদ্যান - বাগান। উদ্যত- প্রবৃত্ত, প্রস্তুত। বিমুখ প্রান্তরে- বিরুদ্ধ পরিবেশের মাঠ, প্রতিকূল পরিবেশে। দিগন্ত প্লাবিত – আকাশ-ছোঁয়া, যে মাঠে দিগন্ত এসে মিশেছে এমন বিশাল। দুর্বাদলে – সবুজ ঘাসে। উলঙ্গ কৃষক – খালিগায়ের দরিদ্র গ্রামীণ কৃষক। করুণ কেরানি – স্বল্প বেতনে দারিদ্র্যের মধ্যে করুণভাবে জীবন-যাপনকারী সাধারণ চাকরিজীবী কেরানি। ভবঘুরে- যাদের কোনো কাজকর্ম নেই, বেকার। পাতা-কুড়ানিরা- যারা পাতা-কুড়িয়ে জীবন ধারণ করে। দরিদ্র কিশোর-কিশোরীর দল। পলকে – মুহূর্তের মধ্যে। দারুণ ঝলকে – প্রচণ্ড ঝলক দিয়ে, প্রচণ্ড আলোর দোলা লাগিয়ে। গণসূর্যের মঞ্চ - জনগণের নেতা, যাঁর তেজীয়ান দ্যুতি চারদিকে বিচ্ছুরিত হচ্ছিল তিনি যেন এক গণসূর্য। মঞ্চ সেই নেতা যে মঞ্চে দাঁড়িয়ে সেটা তো গণসূর্যের মঞ্চ। তাছাড়া সেদিন বিকেলে সূর্যের আলোতে ছিল প্রখরতা। রোধে -বন্ধ করে দেওয়া, বাধা দেওয়া। সবুজ - সবুজময় – সবুজ ঘাসে আবৃত। প্রাণের সবুজ – প্রাণের সজীবতা ও তারুণ্য। মাঠের সবুজ – মাঠের সুন্দর সবুজ পরিবেশ। বজ্রকণ্ঠ – মেঘাচ্ছন্ন আকাশ থেকে বজ্র বা বিদ্যুতের ধ্বনি প্রচণ্ড শক্তিধর শব্দের মতো। এখানে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বরকে বোঝানো হয়েছে। লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা -১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বাংলার মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কণ্ঠনিঃসৃত বক্তব্য শোনার জন্য ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে অপেক্ষা করছিল লক্ষ লক্ষ মানুষ। তারা ব্যাকুল হয়ে বসেছিল বঙ্গবন্ধুর অপেক্ষায় । রেসকোর্সের মাঠে এসে তিনি কী নির্দেশ দেন, কী আশার বাণী শোনান সে জন্য সেদিন লক্ষ প্রাণ হয়েছিল আকুল। কারণ পাকিস্তানি শাসকরা সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের বিজয়কে নস্যাৎ করার সমস্ত পরিকল্পনার ছক তৈরি করে বসেছিল। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির বিজয়কে তারা স্বীকার করে নিতে পারেনি। পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রকারীদের সামরিক প্রতিভূ ইয়াহিয়া খান ১৯৭১-এর ১লা মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করে দেয়। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে শুরু হয় সমগ্র বাঙালি জাতির ঐক্যবদ্ধ অসহযোগ আন্দোলন । বাংলাদেশ হয়ে ওঠে গণমানুষের আন্দোলনে টালমাটাল। ক্ষুব্ধ দেশের মানুষ। ফেটে পড়ছে তাদের ক্রোধ। তারা তাকিয়ে আছে তাদের অকৃত্রিম বন্ধু, প্রাণের মানুষ, কোটি মানুষের নেতা শেখ মুজিবের দিকে। সমস্ত দেশের মানুষ যেন এ বিদ্রোহে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সেদিন রেসকোর্সের মাঠে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা শোনার জন্য যারা এসেছিল সেই লক্ষ লক্ষ মানুষের মনে ছিল ব্যাকুলতা, বঙ্গবন্ধু কী বলবেন আজ। প্রত্যেক শ্রোতাই যেন এক একজন বিদ্রোহী । এ বিদ্রোহ ছিল পাকিস্তানি স্বৈরশাসক ও সামরিকতন্ত্রের এবং অন্যায় ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে। জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে – রমনা রেসকোর্সে সমবেত লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশকে কবি কল্পনা করেছেন জনসমুদ্রের বাগানরূপে। সেই জনসমুদ্রের একদিকে ছিল মঞ্চ, কবির দৃষ্টিতে সেটি যেন সেই জনসমুদ্রের তীর । এই শিশু পার্ক সেদিন ছিল না- বর্তমানে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উত্তরপ্রান্তের একটি অংশজুড়ে রয়েছে শিশু পার্ক। তখন এ শিশু পার্ক ছিল না, তখন এর নাম ছিল রমনা রেসকোর্স। এই রেসকোর্সের উত্তর প্রান্তে নির্মিত বিরাট প্রশস্ত মঞ্চ থেকে ৭ই মার্চ (১৯৭১) বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সেই স্মৃতিময় স্থানটির কোনো অস্তিত্ব এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেখানে এখন নানা রঙ- বেরঙের টুল-বেঞ্চি, খেলনারাজ্য, আর চারদিকে বাগান। কবি মনে করেন, লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয় নিংড়ানো “স্বাধীনতা সংগ্রামের বাণী' যেখান থেকে উচ্চারিত হয়েছিল সে স্মৃতিময় স্থানটি এভাবেই সুকৌশলে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। কখন আসবে কবি? – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কল্পনা করা হয়েছে কবিরূপে । কারণ তিনি বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্ন ও অনুভূতির রূপকার। তাঁর বাঙালি হৃদয়ের আবেগপ্রবণ প্রকাশকে কবিসুলভই মনে হয়। ১৯৭১ সালের ৫ই এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘নিউজউইক' পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ‘রাজনীতির কবি' বলে আখ্যায়িত করে লেখা হয়, তিনি ‘লক্ষ লক্ষ মানুষকে আকর্ষণ করতে পারেন সমাবেশে এবং আবেগময় বাগ্মিতায় তরঙ্গের পর তরঙ্গে তাদের সম্মোহিত করে রাখতে পারেন। তিনি রাজনীতির কবি'। সুতরাং বঙ্গবন্ধুকে 'কবি' অভিধাটি যথার্থভাবেই দিয়েছেন একালের কবি। কবির বিরুদ্ধে কবি ... মার্চের বিরুদ্ধে মার্চ – কবি এখানে বোঝাতে চেয়েছেন বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর এদেশে অশুভশক্তির যে উত্থান ঘটেছে তাতে সব ইতিবাচক ভাবনা, সৌন্দর্য ও কল্যাণকে যেন সমাহিত করার প্রয়াস চলেছে। শ্রেষ্ঠ বিকেলের গল্প – ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে যে বিকেলটিতে লক্ষ লক্ষ মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য, সে বিকেলটি কবির দৃষ্টিতে ছিল বাংলার মানুষের জন্য শ্রেষ্ঠ বিকেল। কারণ এদিন বিকেলেই তিনি স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে – প্রকৃতপক্ষে বাংলার স্বাধীনতাসূর্য অস্তমিত হয় পলাশির প্রান্তরে ১৭৫৭ সালে। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন হয়—সিপাহী বিপ্লব। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রামে স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবী সূর্য সেনের নেতৃত্বে ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র যুদ্ধ হয় জালালাবাদ পাহাড়ে। অতঃপর পাকিস্তান সৃষ্টির এক বছর পর থেকে শুরু হয় পাকিস্তানি শাসকদের নানা ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। ১৯৪৮ সালের ভাষা সংগ্রাম থেকে ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন, তারপর ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। সুতরাং ইতিহাসের বহু অধ্যায় পার হয়ে, নানা সংগ্রাম ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি প্রিয় স্বাধীনতা। অতঃপর কবি এসে মঞ্চে দাঁড়ালেন - বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতামঞ্চে এসে দাঁড়ালেন লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে। তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল/হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার/সকল দুয়ার খোলা, – কবি তাঁর বর্ণনাকে আরও সুন্দর ও অর্থবহ করে তোলার জন্য রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস' ও বিষ্ণু দে'র ‘ঘোড়সওয়ার' কবিতার চরণ ব্যবহার করেছেন খুব নৈপুণ্যের সঙ্গে । বাংলার মানুষের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু তাঁর স্বাধীনতারূপী নৌকার পাল তুলে যখন ডাক দিলেন, তখন জনতার জোয়ারের স্রোতে সে নৌকায় লাগল উদ্দাম হাওয়া, ছুটে চলল সেই স্বপ্নের বহু আকাঙ্ক্ষিত তরী। বজ্রকণ্ঠ বাণী- সহজে উদ্দীপ্ত দ্যুতিময় বঙ্গবন্ধুর বাণী। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির - সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম- ১৯৭১-এর ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেন, এদেশের মুক্তির ডাক দেন। তাঁর বক্তব্যের এটাই ছিল মূলকথা। তাঁর এ আহ্বানে সমগ্র দেশবাসী ঐক্যবদ্ধ হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং অবশেষে আমরা জয়ী হই। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক এই ভাষণটি বিশ্ববিশ্রুত। ২০১৭ সালের ৩০ শে অক্টোবর ভাষণটিকে ইউনেস্কো ‘ঐতিহাসিক প্রামাণ্য দলিল' হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের – ‘স্বাধীনতা' শব্দটি এখন অভিধানের একটি নিছক শব্দ নয়। এ শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে আমাদের সংগ্রাম ও মুক্তির প্রসঙ্গ যুক্ত। তাই ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ যখন বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ থেকে ধ্বনিত হলো : এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, তখন ‘স্বাধীনতা' শব্দটি পেল নতুন অর্থ ও ব্যঞ্জনা ।
‘স্বাধীনতা, শব্দটি আমাদের কীভাবে হলো' কবিতাটি নির্মলেন্দু গুণের চাষাভূষার কাব্য থেকে সংকলিত হয়েছে। কবিতাটির মূলভাব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ, স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের প্রেরণা-সমৃদ্ধ। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু রমনা রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ মানুষের সম্মুখে বজ্রকণ্ঠে পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের নিগড় থেকে বাঙালি জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের মধ্যেই সেদিন সূচিত হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান। সেদিন কৃষক-শ্রমিক-মজুর-বুদ্ধিজীবী-শিশু-কিশোর-নারী- পুরুষ-যুবক-বৃদ্ধ সবাই সমবেত হয়েছিল বাঙালির মহান নেতার কথা শোনার জন্য। সবার মনে ছিল আকুলতা । সে আকুলতা ছিল নেতার কাছে স্বপ্নের কথা শোনার জন্য। তাঁর মুখে আশার বাণী শোনার জন্য। রমনার রেসকোর্সে যেখানে সেদিনের মঞ্চ তৈরি হয়েছিল এখন সেখানে তার কোনো চিহ্ন নেই। সে জায়গায় গড়ে উঠেছে শিশুপার্ক। কবি মনে করেন, অনাগত কালের শিশুদের কাছে এই কথাটি জানিয়ে দেওয়া দরকার যে —এখান থেকেই, এই পার্কের মঞ্চ থেকেই, বাঙালির অমর অজর প্রিয় শব্দ ‘স্বাধীনতা” কথাটি উচ্চারিত হয়েছিল। আপামর জনতার সামনে যিনি সেদিন এসে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি বাঙালির বড় প্রিয় মানুষ, বাঙালির শিকড় থেকে জেগে ওঠা এক বিদ্রোহী নেতা। তিনি কোনো সাধারণ রাজনীতিবিদ নন, তিনি একজন কবি, একজন রাজনীতির কবি। এ দেশের মানুষের ভালোবাসায় গড়া এক মানুষ – জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর - রহমান। তিনি সেদিন (৭ই মার্চ ১৯৭১) বিকেলের পড়ন্ত রোদে ডাক দিয়েছিলেন-
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।'
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই দৃপ্ত ও শাণিত ঘোষণাই বাঙালি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির মন্ত্র হিসেবে কাজ করেছিল। এটাই মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ৷
তোদের অসুর নৃত্য ... ঠা ঠা হাসি ... ফিরিয়ে দিয়েছি
তোদের রক্তাক্ত হাত মুচড়ে দিয়েছি নয় মাসে
চির কবিতার দেশ ... ভেবেছিলি অস্ত্ৰে মাত হবে
বাঙালি অনার্য জাতি, খর্বদেহ ... ভাত খায়, ভীতু
কিন্তু কী ঘটল শেষে, কে দেখাল মহা প্রতিরোধ
অ আ ক খ বর্ণমালা পথে পথে তেপান্তরে ঘুরে
উদ্বাস্তু আশ্রয়হীন ... পোড়াগ্রাম ... মাতৃ অপমানে
কার রক্ত ছুঁয়ে শেষে হয়ে গেল ঘৃণার কার্তুজ।
সাহসী জননী বাংলা, বুকে চাপা মৃতের আগুন
রাত জাগে পাহারায় ... বুড়িগঙ্গা পদ্মা নদীতীর
ডাকাত পড়েছে গ্রামে, মধ্যরাতে হানাদার আসে
ভাই বোন কে ঘুমায়? জাগে, নীলকমলেরা জাগে ।
গ্রেনেড উঠেছে হাতে কবিতার হাতে রাইফেল
এবার বাঘের থাবা, ভোজ হবে আজ প্ৰতিশোধে
যার সঙ্গে যে রকম, সে রকম খেলবে বাঙালি
খেলেছি, মেরেছি সুখে ... কান কেটে দিয়েছি তোদের।
এসেছি আবার ফিরে রাতজাগা নির্বাসন শেষে
এসেছি জননী বঙ্গে স্বাধীনতা উড়িয়ে উড়িয়ে ...
কামাল চৌধুরী ১৯৫৭ সালের ২৮শে জানুয়ারি কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বিজয়করা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আহমদ হোসেন চৌধুরী ও মাতা বেগম তাহেরা হোসেন। ১৯৭৩ সালে তিনি নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৭৫ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরবর্তীকালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে সম্মানসহ স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৬ সালে তিনি গারো জনগোষ্ঠীর মাতৃসূত্রীয় আবাস প্রথা নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পেশায় তিনি সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁর কবিতা বাঙালির আবহমান জীবনচর্যা, সংগ্রাম ও মানবীয় বোধের উৎসারণ, সেই সঙ্গে শিল্পিত প্রকরণের উজ্জ্বল প্রকাশ । তিনি শব্দ ও ছন্দ সচেতন এবং নিরীক্ষাপ্রবণ কবি। বাংলা কবিতায় পরিসুত ধারার অন্যতম প্রধান প্রতিনিধি। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্য : মিছিলের সমান বয়সী, টানাপোড়েনের দিন, এই পথ এই কোলাহল, এসেছি নিজের ভোরে, ধূলি ও সাগর দৃশ্য, হে মাটি পৃথিবীপুত্র, পান্থশালার ঘোড়া ইত্যাদি। কিশোর কবিতা : আপন মনের পাঠশালাতে। সাহিত্যে তাৎপর্যময় অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন।
অসুর নৃত্য – হিন্দু পুরাণ মতে অসুর হলো দেবতাদের শত্রু । দৈত্য বা দানব । অসুর নৃত্য হলো দানবদের নৃত্য। এখানে অসুর নৃত্য বলতে কবি বাংলাদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দানবীয় ধ্বংসলীলাকে বুঝিয়েছেন;
রক্তাক্ত হাত মুচড়ে দিয়েছি – পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালিদের রক্তে তাদের হাত রঞ্জিত করেছিল। প্রতিশোধ হিসেবে কবি সেই কলঙ্কিত হাতকে মুচড়ে দেওয়ার কথা বলেছেন।
চির কবিতার দেশ – বাংলা ও বাঙালি জাতি কবিতার জন্য বিখ্যাত। এদেশের আছে কবিতার সমৃদ্ধ এক ঐতিহ্য। চির কবিতার দেশ বলতে কবি বাংলাদেশকে বুঝিয়েছেন।
বাঙালি অনার্য জাতি – আর্যগণ ভারতে আসার বহু পূর্ব থেকেই অনেক জাতির লোক এদেশে বসবাস করতেন। তারা অনার্য হিসেবে পরিচিত। আর্যগণ অনার্যদের ঘৃণার চোখে দেখতেন, অত্যাচার-অবিচার করতেন। কবি বাঙালিদেরও অনার্য হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন । কিন্তু বাঙালিরা যে ভীতু নয়, দুর্বল বা কাপুরুষ নয়, বরং বীরের জাতি কবি তাদের এই ঐতিহাসিক ও সাহসী পরিচয়ের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।
অ আ ক খ বর্ণমালা পথে পথে— বাঙালির বীরত্ব আর শৌর্যের সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে । সেই ইতিহাসের তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায় ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। ভাষার জন্য বাঙালির আত্মত্যাগের সুমহান প্রেরণার পথ ধরে বাঙালি জাতি এগিয়ে এসেছে মুক্তির পথে, স্বাধীনতার পথে। কবিতার এই অংশে কবি আমাদের ভাষা প্রেমের উদ্দীপনাময় চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন।
ঘৃণার কার্তুজ – ‘কার্তুজ' শব্দটি এসেছে 'কারটিজ' শব্দ থেকে। এর অর্থ হলো বন্দুকের টোটা। ঘৃণার কার্তুজ বলতে কবি বাঙালি জাতির বিস্ফোরণোন্মুখ ঘৃণার সম্মিলনকে বুঝিয়েছেন।
নীলকমলেরা জাগে - নীলকমল অর্থ নীল রঙের পদ্ম। কিন্তু কবি এখানে রূপকথার রাজকুমারদের কথা বলেছেন। আর এই রাজকুমারগণ হলেন ৭১-এর বীর মুক্তিযোদ্ধা যারা দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য দীর্ঘদিন রাত জেগে কাটিয়েছেন।
কবিতার হাতে রাইফেল- কথাটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯৭১ সালে বাঙালি কবিরা কবিতাকেও যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। অর্থাৎ কবিতার মাধ্যমেও প্রতিরোধ ও মুক্তির কথা বলা হয়েছে।
এবার বাঘের থাবা- মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তিশালী আক্রমণ বোঝাতে প্রতীকটি ব্যবহার করা হয়েছে। রাতজাগা নির্বাসন শেষে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের ফলে এদেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ ভিটেমাটি ছাড়া হন । তাঁরা দীর্ঘ নয় মাস নিজ দেশেই কিংবা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে নির্বাসিত জীবনযাপন করতে বাধ্য হন। কিন্তু তাঁরা এ অবস্থাতেই গড়ে তোলেন প্রবল প্রতিরোধ । নির্ঘুম রাত্রিকে তারা উৎসর্গ করেন প্রিয় মাতৃভূমির মুক্তির লক্ষ্যে। এক সময় শত্রুকে পরাজিত করে তাঁরা ফিরে আসেন বীরের বেশে। আলোচ্য অংশে কবি তাঁদের গর্বিত প্রত্যাবর্তনের কথা বলেছেন ।
কবি কামাল চৌধুরীর ‘ধূলি ও সাগর দৃশ্য' কাব্যের অন্তর্গত ‘সাহসী জননী বাংলা কবিতাটি তাঁর কবিতা সংগ্রহ গ্রন্থ থেকে সংকলন করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে—‘ভীতু' ও ‘ভেতো’ বলে যাদের অভিহিত করা হয়েছিল, সে মিথ্যাচার ব্যর্থ করে দিয়ে বাঙালি জাতি তাদের শৌর্যের মহিমায় জয় করে নেয় স্বাধীনতা। মুক্তির পতাকা তাদের হাতে। শত্রুর আসুরিক আচরণ, বিকট উল্লাস আর নৃশংসতা স্বল্প সময়ে পরাভূত করা সম্ভব হয় এ দেশের মানুষের মনে কাব্যময় স্নিগ্ধতার সঙ্গে সাহসের ইস্পাতদৃঢ়তা আছে বলে। অনাদি অতীতের সংগ্রাম, ভাষার জন্য রক্তদানের ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধকালে ছিল বাঙালির প্রেরণার বাতিঘর। এদেশের জনজীবনের বিভিন্ন বাঁকে আছে প্রতিরোধ ও সংগ্রামের ঐতিহ্য। গ্রামবাংলার মানুষ সমন্বিত সংহতিতে পরাভূত করে অশুভ শক্তিকে। আসলে এসবই বাংলাজননীর প্রাণের উত্তপ্ত স্পন্দনজাত, তার মাটি থেকে উঠে আসা সাহসের ফোয়ারাস্নাত। সমস্ত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে এই বীর জাতি বিজয়ের পতাকা উড়িয়ে ফিরে এসেছে দেশমাতৃকার ক্রোড়ে। কবিতাটিতে দৃপ্ত উচ্চারণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গীকার প্রতিফলিত হয়েছে।
যে যাবে না সে থাকুক, চলো, আমরা এগিয়ে যাই।
যে-সত্য জেনেছি পুড়ে, রক্ত দিয়ে যে-মন্ত্র শিখেছি,
আজ সেই মন্ত্রের সপক্ষে নেবো দীপ্র হাতিয়ার।
শ্লোগানে কাঁপুক বিশ্ব, চলো, আমরা এগিয়ে যাই।
প্রথমে পোড়াই চলো অন্তর্গত ভীরুতার পাপ,
বাড়তি মেদের মতো বিশ্বাসের দ্বিধা ও জড়তা।
সহস্র বর্ষের গ্লানি, পরাধীন স্নায়ুতন্ত্রীগুলো,
যুক্তির আঘাতে চলো মুক্ত করি চেতনার জট ।
আমরা এগিয়ে যাবো শ্রেণিহীন পৃথিবীর দিকে,
আমাদের সাথে যাবে সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস,
অনার্যের উষ্ণ লহু, সংঘশক্তি, শিল্পে সুনিপুণ
কর্মঠ, উদ্যমশীল, বীর্যবান শ্যামল শরীর।
আমাদের সাথে যাবে ক্ষেত্রভূমি, খিলক্ষেত্র, নদী,
কৃষি সভ্যতার স্মৃতি, সুপ্রাচীন মহান গৌরব।
কার্পাশের দুকূল, পত্রোর্ন আর মিহি মসলিন,
আমাদের সাথে যাবে তন্তু-দক্ষ শিল্পীর আঙুল ।
চলো, আমরা এগিয়ে যাই। আমাদের সাথে যাবে
বায়ান্নর শহিদ মিনার, যাবে গণ-অভ্যুত্থান,
একাত্তর অস্ত্র হাতে সুনিপুণ গেরিলার মতো ।
আমাদের সাথে যাবে ত্রিশ লক্ষ রক্তাক্ত হৃদয় । (সংক্ষেপিত) )
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ১৬ই অক্টোবর ১৯৫৬ সালে বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস বাগেরহাটের মোংলায়। ১৯৭৪ সালে তিনি ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৭৬ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। অতঃপর ১৯৮০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে সম্মানসহ স্নাতক ও ১৯৮৩ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট’ ও ‘জাতীয় কবিতা পরিষদ' গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। মূলত স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা কবিতায় উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদী কবি হিসেবে তাঁর আবির্ভাব। এছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, দেশাত্মবোধ, গণআন্দোলন ও অসাম্প্রদায়িক জীবনবোধের অসাধারণ এক কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্য: উপদ্রুত উপকূল, ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম, মানুষের মানচিত্র, ছোবল ইত্যাদি। গীতিকার হিসেবেও তিনি জনপ্রিয়তা লাভ করেন । ২১শে জুন ১৯৯১ সালে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর অকালপ্রয়াণ ঘটে।
পরাধীন- অন্যের অধীন। শ্রেণিহীন পৃথিবী- এমন এক পৃথিবী যেখানে মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না, ধনী-দরিদ্র ভেদাভেদ থাকবে না। কর্মঠ- কাজে পারদর্শী, পরিশ্রমী।
উদ্যমশীল- আগ্রহ রয়েছে এমন। কৃষিসভ্যতার স্মৃতি- আমাদের এই বাংলা অঞ্চল কৃষি ক্ষেত্রে খুব উন্নত ছিলো। সেই উন্নত কৃষি সভ্যতার স্মৃতিকে মাথায় রাখার কথা বলা হয়েছে ।
‘মিছিল' কবিতাটি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর ছোবল কাব্য থেকে সংকলন করা হয়েছে। এ কবিতায় কবি অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে মিছিলকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তিনি অনুধাবন করেছেন দেশকে এগিয়ে নেওয়ার মন্ত্রে পথ চলায় আমাদের ভয়হীন ও দৃঢ় হতে হবে। একটি শ্রেণিহীন সমাজ বিনির্মাণের সংগ্রাম ও মিছিলে এ দেশের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস । আমাদের রয়েছে গৌরবজনক কৃষিসভ্যতা, মসলিন কাপড়, কারুশিল্পের ঐতিহ্য। রয়েছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, ত্রিশ লক্ষ শহিদের রক্তাক্ত স্মৃতি। দেশকে এগিয়ে নেওয়ার মিছিলে এসব আমাদের প্রেরণার উৎস।
আরও দেখুন...